একটু চোখ বুলিয়ে নিন
১
ডোনা তার আব্বার কোল থেকে মুখ তুলল।
অশ্রু ধোয়া তার মুখ।
কিন্তু চোখে তার অনেকটা লড়াকু ও বেপরোয়া দৃষ্টি।
তার এই দৃষ্টি গিয়ে পড়ল এলিসা গ্রেসদের উপর। তাদের চোখ-মুখের বিস্ময়ভাবের দিকে চেয়ে ডোনা বলল, ‘আপনারা ভাবছেন, আহমদ মুসার কথা বলে কাঁদছি কেন? ভাবছেন, ওমর বায়ার নাম জানলাম কি করে?’
একটু থেমে একটা ঢোক গিলে নিয়ে ডোনা বলল, ‘আহমদ মুসা আমার সব, আমার জীবন। আর তার কাছেই আমি ওমর বায়ার নাম শুনেছি। তিনি ওমর বায়াকে উদ্ধার করতেই সেইন্ট পোল ডে লিউন-এ এসেছিলেন।’
বলে ডোনা উঠে দাঁড়াল এবং এলিসা গ্রেস ও পিয়েরাকে টেনে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসাল। তারপর লুই ডোমাসের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি ঐ চেয়ারটায় বসুন। দেখুন, এখানে কোন রাজা-প্রজা নেই, আমরা সবাই সমান। বসুন আপনি।’
পিয়েরা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল এবং ডোনাকে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘এখানে রাজা-প্রজা নেই ঠিক, কিন্তু রাজা-প্রজার পরিচয় মিথ্যা হয়ে যায়নি, সময়ের পরিবর্তনে রক্ত পাল্টে যায় না।’
ডোনাকে বসিয়ে দিয়ে লুই ডোমাসের দিকে চেয়ে পিয়েরা বলল, ‘তুমি এস, বিছানায় বস।’
বলে পিয়েরা এলিসা গ্রেসের পাশে গিয়ে বসল।
লুই ডোমাসও বিছানার এক প্রান্তে গিয়ে বসল।
এলিসা গ্রেস, পিয়েরা, লুই ডোমাস তিনজনের চোখেই ডোনাকে ঘিরে একটা নতুন দৃষ্টি, মনে চিন্তার নতুন স্রোত। ডোনার ঋজুতা ও স্পষ্টবাদিতায় তারা মুগ্ধ। ডোনা ও আহমদ মুসার প্রতি তাদের মন নুয়ে পড়ল অফুরান ভালোবাসা এবং ভক্তিতে।
তারা বসতেই ডোনা বলল, ‘গত চারদিন ধরে আহমদ মুসার কোন খবর পাইনি। তাই ছুটে এসেছি আমরা প্যারিস থেকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, খুব কাছে এসেও দেখা পেলাম না।’
কণ্ঠটা কেঁপে উঠল ডোনার। থামল সে। একটা ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলল, ‘তবু আমরা খুশি এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি যে, আপনাদের দেখা পেয়েছি, যারা তার সাথী ছিলেন।’
আবার থামল ডোনা। এলিসা গ্রেসদের দিকে গভীরভাবে তাকাল এবং বলল, ‘এখন দয়া করে কি ঘটেছে বলুন?’ পিয়েরা এবং লুই ডোমাস দু’জনেই এলিসা গ্রেসের দিকে তাকাল। পিয়েরা বলল, ‘এলিসাই সব বলবে। আহমদ মুসা সম্পর্কে শুরুর যেটুকু ঘটনা আমি বলছি।’ একটু থামল পিয়েরা।
তারপর শুরু করল, ‘আমার নামটাই বলা হয়নি। আমি পিয়েরা পেরিন।’
একটু থেমে লুই ডোমাসকে দেখিয়ে বলল, ‘এ হলো লুই ডোমাস। আমার বন্ধুর চেয়েও বড়। এলিসার অনুরোধে ওমর বায়ার অভিযানে আমি জড়িয়ে পড়ি। লুই ডোমাস আমাকে স্বতস্ফূর্তভাবে সাহায্য করে।’ আবার থামল পিয়েরা।
চোখটা একটু নিচু করল। যেন ভাবল এবং গুছিয়ে নিল কথা। তারপর শুরু করল, ‘ব্ল্যাক ক্রস-এর হেডকোয়ার্টার সংলগ্ন তাদেরই নিয়ন্ত্রিত রেস্টুরেন্টের সামান্য পরিচারিকা আমি। খদ্দের হিসেবে আহমদ মুসা আমাদের রেস্টুরেন্টে আসেন।’
তারপর কিভাবে আহমদ মুসার খাওয়া, আচার-আচরণ পিয়েরা পেরিন-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করল, কিভাবে গতকাল এগারটার দিকে পিয়েরা আহমদ মুসার টেবিলে গিয়ে আহমদ মুসার পরিচয় জানতে পারে এবং তাকে ব্ল্যাক ক্রসের হেডকোয়ার্টারের পরিচয় বলে, কিভাবে একজন ব্ল্যাক ক্রসের নেতৃস্থানীয় লোককে দেখিয়ে দেয়, কিভাবে আহমদ মুসা তাকে অনুসরণ করে বেরিয়ে যায় এবং আবার ফিরে আসে এবং আহত হয়ে ব্ল্যাক ক্রসের হাতে বন্দী হয়- সব কথা পিয়েরা পেরিন বলল ডোনাকে।
শুনতে শুনতে ডোনার মুখ মলিন এবং চোখ ছলছলে হয়ে উঠেছিল। পিয়েরা থামতেই ডোনা বলল, ‘খুব বেশি আহত হয়েছিলেন উনি?’ ডোনার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘খুব বেশি না হলেও তার মাথার এক পাশের চামড়া উঠে গিয়েছিল। রক্তে তার মুখের একপাশ এবং শরীরের একটা দিক প্রায় ভিজে গিয়েছিল।’ বলল পিয়েরা পেরিন।
‘কোন চিকিৎসা হয়নি, না?’ দু’হাতে চেয়ারের দু’টি হাতল আঁকড়ে ধরে মাথাটা চেয়ারে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসল ডোনা।
‘ঐ অবস্থায় তাকে ধরে নিয়ে গেছে। ব্ল্যাক ক্রস-এর অভিধানে তার শত্রুর জন্যে হত্যা-নির্যাতন-নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছু লেখা নেই।’ বলল পিয়েরা।
ডোনা কোন কথা বলল না। চোখও খুলল না সে।