Nanga Taloar By Enayetullah Altamash

নাঙ্গা তলোয়ার ১ – এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ (Nanga Taloar 1 By Enayetullah Altamash)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

৬২৯ খ্রিষ্টাব্দ, ৮ম হিজরি। আরব মরুর বুক চিরে মুসাফির চলেছেন একাকী। মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী বিশাল মরু অঞ্চলটি খুবই ভয়ঙ্কর। যে কোন মুহূর্তে বিপদের সম্ভাবনা। একে তো মরুভূমির স্বাভাবিক রুক্ষতা তার উপর আবার লুটেরাদের কবলে পড়ে সর্বস্ব খোয়াবার আশঙ্কা। এ জন্য একাকী সফর করতে কেউ সাহস করত না। লোকেরা দল বেঁধে এ পথে যাতায়াত করত। কিন্তু এ মুসাফির কিছুটা ব্যতিক্রম। তিনি একাকী চলছেন উন্নত জাতের ক্ষিপ্ত গতির অশ্বপৃষ্ঠে। অশ্বের জিনের সাথে তার বর্মটি বাঁধা। কটিদেশে ঝুলানো তরবারি, হাতে বর্শা। প্রাচীনকালে পুরুষেরা দৈহিক দিক দিয়ে উঁচু-লম্বা, প্রশস্ত বুক এবং ভারী শরীর বিশিষ্ট ছিল। এ নিঃসঙ্গ পুরুষ মুসাফিরও তাদের মতই। তবে তাঁর অশ্বপৃষ্ঠে বসার ভঙ্গিই বলছিল, তিনি একজন বীর যোদ্ধা। কোন সাধারণ ব্যক্তি নন। লুটেরারা হামলা করতে পারে এমন কোন আশঙ্কাই তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল না। তাঁর মধ্যে এতটুকু ভীতিও ছিল না যে, তাঁর ঘোড়াটি লুট হয়ে যেতে পারে আর তাঁকে পায়ে হেঁটেই অবশিষ্ট পথ অতিক্রম করতে হবে। তাঁর চেহারাতে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা উঠানামা করছিল। তিনি ছিলেন চিন্তাযুক্ত। মনে হয় অতীতের স্মৃতি আওড়িয়ে ফিরছিলেন অথবা কিছু স্মৃতি ভুলে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন।

ইতোমধ্যে মুসাফির একটি পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছান। তাঁকে বহনকারী অশ্বটি পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। একটু অগ্রসর হয়ে আবার সমতল পথ শুরু হয়। এখানে এসে আরোহী আচমকা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেন এবং ঘোড়া পশ্চাৎমুখী করেন। অশ্বপৃষ্ঠে বসেই তিনি পেছনে ফিরে তাকান। পেছনে ফেলে আসা মক্কা দেখাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। কিন্তু মক্কা দেখা যায় না। অনেক পূর্বেই দূরের মেঘের আড়ালে সে নিজেকে আড়াল করে ফেলেছিল।

“আবু সুলাইমান। পেছনে ফিরো না। মক্কার কথা একদম ভুলে যাও। তুমিতো একজন বীর যোদ্ধা। নিজেকে দু’ভাগে কেটে ভাগ করে দিও না।

তোমার সিদ্ধান্তের উপর অটল থাক। তোমার অভীষ্ট লক্ষ্য এখন মদীনা।” এ ধরনের আওয়াজ যেন তাঁর কর্ণকুহরে ভেসে আসতে থাকে বারবার।

তিনি মক্কার দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেন। অশ্বকে মদীনামখী করেন। যথা নিয়মে অশ্বের বাগে হালকা ঝাঁকি দেন। অশ্বটিও ট্রেনিংপ্রাপ্ত। প্রভুর ইশারা পাওয়া মাত্রই সে বিদ্যুৎগতিতে ছুটতে আরম্ভ করে।

মুসাফিরের বয়স ৪৩। কিন্তু বয়সের তুলনায় তাকে বেশ যুবক দেখাচ্ছিল। তাঁর পুত্রের নাম ‘সুলায়মান’, বাবার নাম ‘ওলীদ’। তবে খালিদ বিন ওলীদের চেয়ে ‘আবু সুলাইমান’ ডাকটা তার নিকট বেশী প্রিয় ছিল। তাঁর জানা ছিল না যে, ইতিহাস তাঁকে ‘খালিদ বিন ওলীদ’ নামে মনে রাখবে এবং এই নামটি ইসলামের গৌরব গাঁথা অনুপ্রেরণার উৎসে রূপান্তরিত হবে।

তখন তিনি মুসলমান হননি। ইতোমধ্যে ছোট-খাটো হামলাসহ উহুদ এবং খন্দকের দু’টি বড় যুদ্ধে তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছেন। যুদ্ধ করেছেন বীরবিক্রমে। অপূর্ব রণকৌশলে।

৬১০ খ্রিষ্টাব্দে যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর সর্বপ্রথম ওহী নাযিল হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর। দূরন্ত ডানপিটে এক যুবক। যৌবনের আভা সমগ্র দেহে প্রতিভাত। তখনই তিনি নিজ গোত্র বনু মাখযুমের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন। কুরাইশের অন্যান্য সাত গোত্রসমূহের মধ্যে বনু মাখযুম অন্যতম ছিল। কুরাইশদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা এই গোত্রের উপরই ন্যস্ত ছিল। কুরাইশরা হযরত খালিদের পিতা ওলীদের কথা মেনে চলতো। ২৪ বছর বয়সেই খালিদ স্বীয় যোগ্যতা ও দক্ষতা বলে বাবার মত কুরাইশ জাতির শ্রদ্ধা ও আস্থা হাসিল করেন। কিন্তু এই বিরাট সামাজিক মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে বরং তা চিরতরে বিসর্জন দিয়ে খালিদ আজ মদীনার পানে ছুটে চলছেন।

দীর্ঘ পথ অতিক্রম কালে কখনো তাঁর মনে হত, একটি অদৃশ্য শক্তি যেন পশ্চাৎ থেকে তাকে টেনে ধরছে। যখন এই শক্তির উপস্থিতি তাঁর অনুভূত হত তখন তিনি ঘাড় ফিরিয়ে পশ্চাতে তাকাতেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ যেন আরেকটি আওয়াজ তিনি শুনতে পেতেন, “খালিদ! পশ্চাতে নয়, সম্মুখে তাকাও। মনে রেখো, যদিও তুমি ওলীদের পুত্র কিন্তু এখন সে মৃত। এখন তুমি সুলাইমানের পিতা। আর সে বেঁচে আছে।”

তার স্মৃতিতে দু’টি নাম ভেসে উঠে। ১. মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম; যিনি এক নতুন মতাদর্শের সূচনা করেছেন। ২.ওলীদ; যে একদিকে তাঁর পিতা এবং অপরদিকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর নব আদর্শের কট্টর দুশমন ছিল। পিতা এই বৈরিতা খালিদের দায়িত্বে অর্পণ করে মারা যায়।

খালিদের ঘোড়াটি দূরে পানির কূপ দেখে সেদিকে যেতে থাকে। তিনি ঘোড়ার গমন পথে দৃষ্টি দিয়ে জায়গাটি পর্যবেক্ষণ করেন। বৃত্তকায় একটি এলাকায় কিছু খেজুর গাছ আর বিক্ষিপ্ত কতক সরু কাণ্ড তাঁর নজরে পড়ে। সব মিলিয়ে এটি একটি ছোট ঝোপ ছিল ঘোড়ার গতি ছিল সেদিকেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top