একটু চোখ বুলিয়ে নিন
সুন্দর-সুরম্য নগরী তায়েফ। বাগিচাঘেরা লোকালয়। সবুজ-শ্যামলিমায় ভরপুর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতীক। ফুরফুরে শীতল স্নিগ্ধ বায়ুরা মর্মর আওয়াজ তুলে সর্বদা সেখানে নেচে বেড়ায়। সুকণ্ঠ পাখিরা শিস দিয়ে যায়। ইথারে-পাথারে কম্পন জাগে। আকর্ষণীয় ও মোহময় হয়ে ওঠে পরিবেশ। কলোলিত এবং মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা।
সারি সারি কাঁদি ঝুলানো খর্জুর বিথীকায়। থোকা থোকা সুস্বাদু আঙ্গুর মাচায় মাচায়। ফুলের সৌরভ আর ফলের ঘ্রাণে চারদিক মৌ মৌ। ঝাঁকে ঝাঁকে মক্ষিকারা উল্লাসে গুঞ্জরিত। বাতাসে বাতাসে ফুল-ফলের আকুল করা কাঁচা ঘ্রাণ। আকাশের পাখিরা উড়ার পথে এখানে এসে থমকে দাঁড়ায়। ব্যস্ত মুসাফিরের দৃষ্টিও এখানে এসে ক্ষণিকের জন্য আটকে যায়। কলোলিত মুকুলিত মুখরিত এই উদ্যানে এলে চরম দুঃখীও তার দুঃখ ভুলে যায়। বিরহী হৃদয়ে সান্ত্বনা পায়। বিধবা চোখে আলো দেখে। ইয়াতীমের মুখে হাসি ফোটে। হতাশা দূর হয়। বিষাদিত হৃদয়ে হর্ষের তরঙ্গ ওঠে। অশ্রুসজল চোখের পাতায় আনন্দধারা খেলা করে। মলিন ঠোঁটে জাগে হাসির আভা। চেহারার কালো আবরণ দূর হয়ে প্রফুল্লতা ঝিকমিক করে।
তৎকালে তায়েফ ছিল ভূ-স্বর্গ। মরুভূমির শোভা। চারদিকে অথৈ বালুর পাহাড় আর সারি সারি টিলা অধ্যুষিত বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে তায়েফ যেন কণ্ঠাহারের লকেট। এই ভূস্বর্গটি আরবের বিখ্যাত যুদ্ধবাজদের দখলে ছিল। এখানেই ছিল দুর্ধর্ষ ছাকীফ গোত্রের হেডকোয়ার্টার। বসতির কাছেই ছিল গোত্রীয় উপাসনালয়। বনু ছাকীফ, হাওয়াযিন সহ আরো কয়েকটি গোত্রের দেবতা ‘লাত’-এর মূর্তি এখানে স্থাপিত ছিল। এটা মূলত কোন আকৃতিগত প্রতীমা ছিল না; বরং একটি প্রশস্ত চত্বর ছিল মাত্র। মানুষ এ প্রান্তরের চত্বরকেই দেবতা মনে করে তার পূজা-অর্চনা করত।
উপাসনালয়ে অত্র এলাকার সন্ন্যাসীও থাকত। মানুষ তাকে খোদা এবং দেবতা ‘লাত’-এর দূত মনে করত। সন্ন্যাসীর কাজ ছিল শুভাশুভ নির্ণয়ের মাধ্যমে অনাগত বিপদ থেকে মানুষকে সতর্ক করা। সে সাধারণ মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকত। কালে ভদ্রে হয়ত কেউ তার দেখা পেত। উপাসনালয়ের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত লোকজন ছাড়া সাধারণ মানুষের সাথে তার দেখা হত না। ভাগ্যক্রমে কেউ তাকে দেখলে সে অত্যন্ত আনন্দিত হত। যেন সে স্বয়ং খোদাকেই দেখার দুর্লভ সম্মান অর্জন করেছে। দেবতা তায়েফে থাকায় মানুষের দৃষ্টিতে তায়েফের এক ভিন্ন মর্যাদা ছিল। সবাই এ ভূমিকে পবিত্রভূমি বলে সম্মান করত।
মাত্র এক মাস পূর্বে তায়েফে অত্যন্ত আড়ম্বরের সাথে একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান হয়েছিল। স্বাগতিক এলাকার সর্বোচ্চ নেতা মালিক বিন আওফ তার গোত্রের অনুরূপ আরেকটি শক্তিশালী গোত্র হাওয়াযিন এবং আরো কয়েকটি গোত্রের নেতৃবৃন্দকে এক বিরাট ভোজসভায় আমন্ত্রণ করেছিল। আনুষ্ঠানিক মনোজ্ঞ করতে বাছাই করা সুন্দরী নর্তকী এবং শিল্পীদের আনা হয়েছিল। তাদের নৃত্য নৈপুণ্য এবং সুর-লহরী শ্রোতাদের দারুণ মুগ্ধ ও তন্ময় করেছিল। সে রাতে মদের বোতল একের পর এক শুধু খালিই হচ্ছিল।
শ্রোতা মাতানো রাতের সে অনুষ্ঠান মালিক বিন আওফের অঙ্গুলি হেলনে থমকে গিয়েছিল। বিভিন্ন গোত্রের নেতৃবৃন্দ আলোচনা-সমালোচনা এবং পর্যালোচনার পর সে রাতে এই মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয় যে, আচমকা আক্রমণ করে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মক্কার মুসলমানদের চিরদিনের জন্য খতম করে দিবে। বয়োবৃদ্ধ এক নেতা দুরায়দ বিন ছম্মাহ সেদিন আহ্বান করেছিল—চল, দেবতা লাতের নামে শপথ করি যে, মক্কার মূর্তিবিনাশী মুহাম্মদ এবং তার চেলা-চামুণ্ডাদের খতম করেই তবে আমরা স্ত্রীর সামনে যাব।
ত্রিশ বছর বয়সী মালিক বিন আওফ সেদিন আবেগে ফেঁটে পড়ছিল। সে বড় দৃঢ়তার সাথে বলেছিল, এবারের বহুজাতিক বাহিনী মক্কায় মুসলমানদের অজ্ঞাতেই তাদের টুটি চেপে ধরবে।
সে রাতে মালিক বিন আওফ, দুরায়দ বিন ছম্মাহ এবং অন্যান্য গোত্রের নেতৃবৃন্দ এলাকার সন্ন্যাসীর কাছে গিয়েছিল। তারা সন্ন্যাসীর কাছে দুটি বিষয় জানতে চেয়েছিল।
১. মক্কায় গিয়ে মুসলমানদের অজ্ঞাতে তাদের টুটি চেপে ধরা তাদের পক্ষে সম্ভব কি-না?
২. আচমকা এবং অকল্পনীয় হামলা মুসলমানদের শির-দাঁড়া ভেঙ্গে দিবে কি-না?