একটু চোখ বুলিয়ে নিন
প্রতিবেশী মুসলিম শাসকদের মধ্যে এলিখ খান ছিলো সুলতানের জঘন্যতম শত্রু। সুলতানের অনুপস্থিতির সুযোগে একবার সে গজনী দখলের উদ্দেশে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে আগ্রাসন চালিয়েছিলো। কিন্তু তাকে গজনী বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে জীবন নিয়ে পালাতে হয়েছিলো। হিন্দুস্তান থেকে সংবাদ পেয়ে বিদ্যুৎগতিতে গজনী ফিরে এসে সুলতান নিজে এলিখ খানকে প্রতিরোধ করেছিলেন। এলিখ খান সুলতানের শাসনাধীন খোরাসান অঞ্চল দখল করে নিতে তৎপর ছিলো।
“মাননীয় সুলতান! এলিখ খান একটি বিষধর সাপ । ও যতদিন বেঁচে থাকবে, ততোদিন সুযোগ পেলেই আমাদের দংশন করতে থাকবে।” বলছিলেন সুলতান মাহমুদের কাছে আগত দুই গোয়েন্দা কর্মকর্তার একজন। এদের একজন সুলতানের নির্দেশে এলিখ খানের সেনাবাহিনীর মধ্যেই কাজ করতো। তারা জানালো, এবার আপনার অনুপস্থিতিতে এলিখ খান তার ভাই তোগা খান ও কাদের খানকে প্ররোচিত করছিলো তারা যেনো আপনার বিরুদ্ধে সামরিক সংঘাতে তাকে সহযোগিতা করে। তারা তিনজন মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে সকল সেনাবাহিনী নিয়ে গজনী আক্রমণ করে দখল করে নিতে চাচ্ছিলো। কিন্তু তোগা ও কাদের খান আপনার ভয়ে এলিখ খানের সহযোগী হতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে এলিখ খান তার ভাই তোগা খানের বাদশাহী দখল করার জন্য সেনা অভিযান চালায়। কিন্তু উজগন্দ নামক স্থানে পৌঁছার পর তাদের উপর প্রচণ্ড তুষারপাত ও ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। ফলে এলিখ খানের সৈন্যদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। বিপুলসংখ্যক সওয়ারী ও সৈন্য প্রচণ্ড তুষারপাতের কবলে পড়ে মারা যায়। প্রাকৃতিক প্রতিরোধের মুখে বড় ধরনের ক্ষতি সাধিত হয়। বাধ্য হয়েই এলিখ খান সেনাভিযান পরিহার করে আপন রাজধানীতে ফিরে আসে।
“তোগা খান কী করতে চায়?” জানতে চাইলেন সুলতান।
তিনি আপনার সহযোগী। আমাদের যে সহকর্মী তোগা খানের সেনাবাহিনীতে কর্মরত, সে খবর দিয়েছে, এলিখ খানের অভিযান প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যর্থ হওয়ার পর তাকে হুঁশিয়ার করে পয়গাম পাঠায়, যদি পুনর্বার সে তার রাজ্যের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায়, তাহলে তিনি সুলতানের সাথে মৈত্রী গড়ে তুলবেন।”
“তোগা খানকে কি বিশ্বাস করা যায়?”
“মাননীয় সুলতান! কারো মনের কথা তো আর বলা যায় না। কিন্তু বাহ্যিক দৃষ্টিতে যা বোঝা যায়, তাতে তোগা খান আপনার সাথে মৈত্রী স্থাপনে আগ্রহী।”
“এর অর্থ হলো, এলিখ খানের মতো একজন হিংসুটে ক্ষমতালি আগ্রাসীর দুস্কৃতি থেকে নিজের রাজ্য ও শাসনের নিরাপত্তার জন্য তোগা খান আমাদের সাথে মৈত্রী গড়তে আগ্রহী।” ব্যাখ্যা করলেন সুলতান। “ঠিক আছে, আমি তার সাথে মৈত্রী স্থাপনে অস্বীকৃতি জানাবো না। তবে তোগা খানের সাথে আমার একবার সাক্ষাৎ হওয়া দরকার। এসব ক্ষমতালোভী মুসলিম শাসক আমাদের জন্য পায়ের বেড়িতে পরিণত হয়েছে।… তোমরা তোগা খানকে খুবই গোপনে একথা জানিয়ে দাও যে, আমি শীঘ্রই তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাচ্ছি। সাক্ষাতের জন্য তাকে আমার কাছে আসতে হবে না, আমিও তার কাছে যাবো না। গজনীর বাইরে যতো দূরেই থোক সেখানে চলে আসলে আমি নিজে গিয়ে সেখানে তার সাথে সাক্ষাৎ করবো।”
এসব কারণে বিজয়ের উল্লাসে শরীক হতে পারেননি সুলতান। অভ্যন্তরীণ হিংসা আর স্বজাতির ক্ষমতলিন্দু শাসকদের প্রতিহিংসায় গৃহযুদ্ধের খড়গ সবসময় সুলতানের মাথার উপর ঝুলন্ত ছিলো। তিনি এ পর্যায়ে এসে অনুভব করলেন, ঘরের ভেতরের এই বিষধর সাপগুলোর মাথা পিষে ফেলা এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অত্যন্ত সংগোপনে সুলতানের গোয়েন্দারা তোগা খানের কাছে তার পয়গাম নিয়ে গেলে সাক্ষাতের ব্যাপারে তিনি কোন আপত্তি করেননি। তিনি গজনী থেকে নিরাপদ দূরত্বে একটি জায়গার কথা বলে দিলেন। চারদিন পর সেই জায়গায় দুই শাসকের সাক্ষাতের সময় নির্ধারিত হলো।
সময়মতো ঠিক জায়গায় তোগা খান পৌঁছে গেলো। জায়গাটি ছিলো প্রাকৃতিক নিসর্গে ভরপুর মনোরম। একটি খরস্রোতা নদীর পাশে ঘন গাছগাছালী আর বনফুলের সমাহারে সবুজ-শ্যামল জায়গায় তোগা খান ও সুলতানের সাক্ষাৎ হলো। সুলতান তোগা খানকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।
“এ কথা কি সত্য যে, আপনি আমার সাথে মৈত্রী স্থাপন করতে চান? আমি আপনার কাছে পয়গাম দিয়ে দূত পাঠানোর কথা ভাবছিলাম, ঠিক সেই সময় আপনার পয়গাম পেয়ে আপনার ডাকে সাড়া দিলাম। আমি আপনার সাথে মৈত্রী চুক্তি করতে আগ্রহী।” বললেন তোগা খান।
“আপনার এই মৈত্রী স্থাপনের উদ্দেশ্য কি আপনার রাজত্বের নিরাপত্তার জন্য, নাকি মুসলমানরা পরস্পর মিলেমিশে থাকা আল্লাহর নির্দেশ- এ জন্য? আপনি যদি রাজত্বের নিরাপত্তার জন্য মৈত্রী স্থাপনে আগ্রহী হয়ে থাকেন, তাহলে সেই মৈত্ৰীতে আমার কোন আগ্রহ নেই। আমি শুধু বাগদাদ খেলাফতের অধীনে মৈত্রী স্থাপন করতে পারি। আমি চাই স্বাধীন মুসলিম রাজ্যগুলোর অস্তিত্ব থাকুক, সবাই খেলাফতে বাগদাদকেই মুসলমানদের কেন্দ্র বলে স্বীকার করে নিক। ইসলামকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে সকল মুসলিম শাসকের খেলাফতের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই।” সুলতান বললেন।