Masud Rana - Drug Lord

ড্রাগ লর্ড – মাসুদ রানা – কাজী আনোয়ার হোসেন (Drug Lord – Masud Rana By Kazi Anwar Hossain)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

প্যারিসের এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা । ল্যাটিন কোয়ার্টারের বৃক্ষশোভিত প্রশস্ত রাস্তার দু’পাশে ছোট ছোট বাড়ি গুলোর টালির ছাতে একনাগাড়ে আঘাত হেনে চলেছে বৃষ্টির ফৌটা। ডি লা কনকর্ডের কালো-রূপালী মস্ত খোলা জায়গাটা ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে চকচক করছে। ক্রিলন ও জর্জ ফাইভ রেস্তোরা দুটোর ডোরম্যানরা একটু পর পরই গিয়ে অন্ধকার থেকে ট্যাক্সি ডেকে আনছে, তারপর ছাতা নিয়ে ট্যাক্সিতে তুলে দিচ্ছে ফারের দামি পোশাক পরা অতিথিদের ।

শহরের উত্তরতম প্রান্তে, ওঅকওয়ে ধরে হেঁটে চলেছে করিম মোল্পা। মাথার ওপরে ছাউনি থাকায় বৃষ্টি লাগছে না গায়ে । কিশোর বয়েসেই ভয়ে ভয়ে অপরাধ জগতে ঢুকে পড়েছিল ও আর ওর তিন ভাই । সেটা বহু বছর আগের কথা ! এখন
কাউকে ভয় পায় না করিম।

সোডিয়াম আলোয় আলোকিত রাস্তার দুপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছাউনির নীচ থেকে বৃষ্টিতে বেরিয়ে এল ও । ধূসর-বাদামি মুখের চামড়া, বসা চোয়াল, কালো ঘন ভুরুর মাঝখান থেকে যেন ঠেলে বেরিয়ে এসেছে অনেক বড়, বাকা নাকটা । পরনের নীল ট্রাউজারের ফুলে থাকা পিছনের পকেটে চাপ দিল ও, নিশ্চিত হয়ে নিল পলিথিন ব্যাগে রাখা কড়কড়ে নতুন পচিশ হাজার ফ্রাঙ্কের নোটগুলো ঠিকঠাক আছে কি না। একসঙ্গে এত টাকা জীবনে এই প্রথম হাতে পেয়েছে।

ছায়া থেকে সরে এসে হাতঘড়ির দিকে তাকাল করিম। এবার নিয়ে পাঁচ ছয়বার ঘড়ি দেখা হয়ে গেছে! কাকে দেখতে পাবে জানে না, কারণ, কখনোই এক লোককে দুবার দেখে না। যে লোক মাল সরবরাহ করে সে ভীষণ সতর্ক থাকে, ধরা পড়ার ভয়ে এক লোককে দুবার পাঠায় না । করিমও খুব সতর্ক । এসব কাজে সামান্যতম অসতর্কতার খেসারতও যে অনেক সময় প্রাণ দিয়ে দিতে হয়, জানা আছে ওর।

গলোয়া সিগারেটের হালকা নীল প্যাকেটের এক পাশ খুলে ওটা ঠোটের কাছে ধরল করিম । জিভ আর ঠোটের সাহায্যে একটা শলা টেনে বের করে নিল । সস্তা লাইটার জ্বেলে সিগারেটটা ধরাচ্ছে, অন্ধকার থেকে কথা বলে উঠল একটা কণ্ঠ । লাফিয়ে ছায়ায় সরে গেল করিম । অসতর্ক হওয়ার জন্য, ওর ওপর যে নজর রাখা হচ্ছিল, বুঝতে না পারার জন্য মনে মনে গালি দিল নিজেকে । ট্রাউজারের পাশের পকেটে ঢুকে গেল এক হাত– –চেপে ধরল ছোরাটা। অনেক ছোটবেলায় অ্যালজিয়ার্সের নোংরা বস্তিতে যখন থাকত, তখন থেকেই এই অস্ত্রটা ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী ।

সোডিয়াম আলোব নীচে এসে দাড়াল আর্মি গ্রেটকোট পরা খাটো একটা মুর্তি। মাথায় পুরানো কেপি, ফরাসি সামরিক বাহিনীর লোকেরা সাধারণত এ ধরনের টুপি পরে থাকে। বৃষ্টির পনি গড়িয়ে পড়ছে কেপির কিনারা থেকে । ওর মুখ দেখতে পাচ্ছে না করিম ৷ মোলায়েম চাপা খসখসে কণ্ঠে ইংরেজিতে বলল, ‘ফ্ল্যান্ডারের মাঠে পপির ফুল ফুটেছে।’

সাংকেতিক কথার জবাবে করিম বলল, ‘সারি সারি ফুল ছেয়ে গেছে মাঠ।’ সিড়ির ধাপে একটা বাদামি ক্যানভাসের ব্যাগ নামিয়ে রেখে পিছিয়ে গেল লোকটা। দুই হাত কোটের পকেটে ঢোকানো । এক হাতে যে একটা পিস্তল চেপে ধরেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। করিমের। নীল ট্রাউজারের পকেট থেকে পলিথিনে মোড়ানো টাকাগুলো বের করল ও। ব্যাগটার পাশে নামিয়ে রেখে পিছিয়ে গেল। সবসময় এ ভাবেই কাজ করে–ছোয় না। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে । নিচু হয়ে টাকা তুল নিল আগন্তক । গোনার প্রয়োজন বোধ করল না। টাকার প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে মাথা সামান্য কাত করে ঝাঁকি দিয়ে কোটের পকেটে গুজে রাখল । তারপর সরে গিয়ে করিমের ন্ড়ার অপেক্ষা করতে লাগল।

এগিয়ে এসে ঝুঁকে ব্যাগ ভুলে নিল করিম । ওজনটা ঠিকই আছে, ভিতরে বালি ভর্তি মনে হলো না! ওপরে-নীচে ঝাকি দিল, নিঃশব্দে নড়ল ভিতরের জিনিসগুলো, শুকনো পাউডারের মতই। কাজ শেষ। এখন অন্য লোকটার যাওয়ার অপেক্ষায় রইল ও | এটাই নিয়ম। মাল নিয়ে কোনদিকে যায় ও, এমনকী
কোনদিকে যেতে চায়, সেটাও বুঝতে দিতে চায় না।

নড়ছে না লোকটা । ওর দিকে তাকাল করিম। হঠাৎ করেই যেন লক্ষ করল ব্যাপারটা-আশপাশের যানবাহনের শব্দ কানে ঢুকল, ‘ওঅকওয়ে থেকে নীচে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেল।

কোথাও কী একটা যেন গোলমাল হয়েছে গিরগিটির মত নিঃশব্দে দেয়াল ঘেষে হাটতে শুরু করল করিম, হারিয়ে ষেতে চাইছে রাতের অন্ধকার নিরাপত্তায় । দুই লাফে কাছে চলে এল লোকটা! প্রচণ্ড শক্তি লোকটার গায়ে-করিমের ঘাড়
চেপে ধরে নাক-মুখ ঠুকে দিল দেয়ালে । ভর্তা হয়ে গেল নাকটা। প্রায় ছুঁড়ে ফেল্কল কনক্রিটের ফুটপাথে । দক্ষ, অভ্যস্ত, দ্রুতহাতে ওর হাত দুটো পিঠের ওপর নিয়ে এসে হাতকড়া লাগিয়ে দিল লোকটা । নিশ্চয় পুলিশ, ভাবছে করিম, কিন্তু
ওরা কীভাবে…

হ্যাচকা টানে তুলে ওকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো । কানের পিছনে পিস্তলের নল চেপে ধরা হলো । সেফটি ক্যাচ রিলিয করার শব্দ শুনল করিম । একটা সিঁড়ির গোড়ায় করিমকে টেনে নিয়ে গেল লোকটা । দেয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরে পকেট
থেকে একটা কাঠের গোজ বের করল । ওটার এক মাথা করিমের মুখে বসিয়ে পিস্তলের বাট দিয়ে সজোরে বাড়ি মারল অন্য মাথায় । অনেকগুলো দাত ভেঙে ভিতরে ঢুকে গেল গৌজটা। এবার পকেট থেকে বড় একটা প্রায়ার্স বের করল
লোকটা । করিমের মুখের ওপর ঝুঁকল ও ।

এই প্রথম লোকটার মুখের হলদেটে চামড়া পলকের জন্য দেখতে পেল করিম। যারা মুখ বন্ধ রাখতে পারে না” অশুদ্ধ ফরাসিতে বলল লোকটা, “তাদের এই ব্যবস্থাই করি আমরা ।’

মুখের ভিতর ঢুকিয়ে প্লায়ার্স দিয়ে করিমের জিভ চেপে ধরল লোকটা।

ডা ভোজেস-এর কাছে ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্টে মিস্ট্রেসকে নিয়ে ডিনার করছে ফ্রা থিয়াখি। তামার রেইলে লাগানো জালের পর্দায় জানালার নীচের অংশটা ঢাকা, ওপরের অর্ধেকটা দিয়ে স্কয়ারের একটা কোণ চোখে পড়ছে, সারি সারি স্তম্ভের ওপর বসানো ছাউনি থেকে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ছে।

আজ শুক্রবার । ওর নিয়মিত একঘেয়ে কাজের মধ্যে একমাত্র আকর্ষণ। ডুক্সেমের অফিসে কাজ থেকে উঠে, পাতালরেলে করে মেট্রোর সেইন্ট পল-এ এসেছে, এখানে ম্যারাই-এর ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে থাকে ওর .
মিস্ট্রেস। কসাইপট্রির ধার দিয়ে সরু গলি ধরে হাটার সময় সতর্ক থেকেছে ও, সারাক্ষণ লক্ষ রেখেছে কেউ পিছু নিল কি না, তারপর পুরানো বাড়িটার সামনে দাড়িয়ে আদিম বেল-পুল টেনে ঘন্টা বাজিয়েছে।

সিক্রেট এজেণ্টের জন্য ব্যভিচার কত সহজ, ভেবে মনে মনে এক ধরনের শান্তি পেয়েছে ও, বার বার রাস্তার দুই পাশ দেখেছে চঞ্চল দৃষ্টিতে । বাড়ির ভিতর থেকে পায়ের আওয়াজ শোনা গেছে, দরজা খুলে দিয়েছে বাড়ির মালিক মাদাম
ক্রিন্ত। মস্ত ভুড়িওয়ালি প্রৌঢ়া মহিলা, পুরু লেন্সের ওপাশ থেকে ওর সদাসন্দিহান চোখ দুটো যেন সার্বক্ষণিক ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সবার দিকে, থিয়াখির বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে, চিনতে পেরে নেহায়েতই অনিচ্ছার সঙ্গে যেন পথ ছেড়ে দিয়েছে । মাদামকে আবারও এক বাক্স ভায়োলেট ফুলের গন্ধওয়ালা চকলেট উপহার দেয়ার সময় হয়েছে, ভেবেছে ও । চত্বর পেরিয়ে সিড়ি বেয়ে সোজা কোরির দরজার কাছে চলে এসেছে। কোরির বয়েস চল্লিশের কোঠার মাঝামাঝি । বিধবা হয়েছে বহুদিন আগে । এই বয়েসেও ফিগারটা ঠিক রেখেছে ও । চর্বিহীন পেট, সোনালি চুল, আকর্ষণীয় চেহারা ।

ওর ভেজা কোটটা নিয়ে ঝাড়া দিয়ে পানি ফেলেছে কোরি । দুটো গ্রাস, এক বোতল রিকার্ড, এক জগ পানি টেবিলে রেখে দিয়েছিল আগেই । থিয়াখি ঢুকতে একটা প্যাকেট থেকে টোস্ট বিস্কিট বের করে মাখন মাখিয়ে প্লেটে রেখেছে। পানি মেশানো রিকার্ড দিয়ে একটা টোস্ট খেয়ে নিয়ে প্রথমে বেডরুমে ঢুকেছে ওরা। তারপর বাথরুমে ঢুকে একসঙ্গে গোসল সেরে রেস্টুরেন্টে এসে ডিনারে বসেছে।

কথা বলতে বলতে খাচ্ছে দুজনে, এই সময় পকেটে রাখা থিয়াখির মোবাইলটা বেজে উঠল । বিরক্ত ভঙ্গিতে যন্ত্রটা বের করে, কে ফোন করল নাম দেখে নিয়ে কানে ঠেকাল। ওর ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি সেকশন হেড । নীরস কণ্ঠে থিয়াখি বলল, “বলুন ।” একটা খুন হয়েছে, ফ্রা, ডেপুটি বলল।

‘তো আমি কী করব? পুলিশকে জানান ।’

পুলিশই ফোন করে জানিয়েছে আমাকে । ওরা খুব উদ্বিগ্ন। আগের একটা খুনের সঙ্গে এর মিল আছে।’
তা-ই?

তোমাকে একবার দেখতে যেতে হবে ।’

“এখন?

‘হ্যা। গাড়ি পাঠাচ্ছি। কোথায় আছো?”

“সেইন্ট পল মেট্রোতে আসতে বলুন ড্রাইভারকে ।’

ভাগ্যিস, ঘরে ঢুকে আগেই কাজটা সেরে নিয়েছিল–ভেজা, স্যাতসেতে কোট গায়ে দিতে দিতে ভাবছে থিয়াখি। হাত বাড়িয়ে হুক থেকে হ্যাটটা তুলে নিল। ফোনকলটা আর একঘণন্টা আগে এলে দিনটাই বরবাদ হয়ে যেত।

রিয়ো ডা রিভোলিতে স্টেশনের প্রবেশ মুখের কাছে দাড়িয়ে আছে কালো রঙের একটা সিত্রো গাড়ি । ইঞ্জিন চলছে। বছরের এ সময়টায় সাধারণত সুইচ অফ করে না এখানকার ড্রাইভাররা, বন্ধ করে দিলে ইঞ্জিন এত ঠাণ্ডা হয়ে যায়,
হাইড্রোনিউম্যাটিক সাসপেনশন পাম্প করে আবার গরম করতে হয়, আর তাতে অনেক সময় লাগে । স্টেশন থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠল থিয়াখি। স্প্রিং লাগানো সিটে বসতেই অনেকখানি দেবে গেল পুরু গদি। গিয়ার দিয়ে এত দ্রুত হুইল ঘোরাল ড্রাইভার, ইঞ্জিনের সঙ্গে সমতা রাখতে গিয়ে আর্তনাদ করে উঠল চাকার রাবার ।

একটা আমেরিকান সিগারেট ধরিয়ে জানালার বাইরে তাকাল থিয়াখি। তীব্র গতিতে সরে যাচ্ছে মস্ত বুলেভার্ডের পাশের দোকানগুলো, দ্য গ্যালারিস লাফায়েত, দ্য মনোপ্রি, ইত্যাদি । গ্যারি দু নর্ড পেরিয়ে এসে পাশের সরু গলিতে নামল ড্রাইভার । এখানে রয়েছে কতগুলো ইন্দো-চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আর সেকেন্ড হ্যাণ্ড আসবাবপত্রের দোকান ।

পুরানো শহরের অসংখ্য খালের ওপরের ব্রিজ ও জালের মত বিছিয়ে থাকা ট্রাফিক সিসটেমের মধ্য দিয়ে ওরা এগিয়ে চলল, পেরিয়ে এল পোর্টে দ্য ক্লিজন্যানকোর্ট ও সেইন্ট ডেনিস; এমন একটা রাস্তায় পড়ল যেটাকে দেখে মনে হয় দুপাশের টাওয়ারের মত উচু বাড়িগুলোর মাঝখানে নাক ঢুকিয়ে দিয়েছে। শেষ মাথায় অন্ধকার, প্যারিস শহরের পরিচিত বাতি নেই ‘এখানে, কালো একটা মস্ত বদ্ধ ঘরের মত লাগছে জায়গাটাকে।

সাঁই সাঁই স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে এন-১ থেকে নেমে এসে একটা সরু রাস্তায় নামল ড্রাইভার, দুই-তিন মিনিট জটিল রাস্তায় যেন হাবুডুবু খাওয়ার পর আর্ক এন সিয়েল-এর পাশে গাড়ি থামাল।

সিত্রোর হেডলাইটের আলোয় দেখা গেল, অতিরিক্ত পুরানো, রংহীন একটা বড় বাড়ির সিঁড়ির গোড়ায় পাহারা দিচ্ছে ইউনিফর্ম পরা একজন পুলিশম্যান ।

আশপাশে তাকিয়ে অন্য কোন মানুষ চোখে পড়ল না থিয়াখির, ওই একজন পুলিশ ছাড়া যেন পুরো এলাকায় আর কেউ নেই, ছিল না কোনও দিন ।

গাড়ি থেকে নেমে, রাস্তা পেরিয়ে পুলিশম্যানের সামনে দাঁড়াল ও । কার্ড বের
করে দেখাল। ‘লাশটা কোথায়?

“মর্গে নিয়ে গেছে, মসিয়ে”

“পরিচয় জানা গেছে?

নোটবুক বের করল পুলিশম্যান।

“করিম মোল্লা । বয়েস সাইত্রিশ । আর কিছু জানি না।’

পুলিশের খাতায় রেকর্ড আছে?
না, মসিয়ে। তবে তাতে কিছু বোঝা যায় না। এই এলাকায় প্রচুর অপরাধী আছে, যাদের কোনোই রেকর্ড নেই। এদিকে খুব একটা আসিও না আমরা

“তারমানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে ওরা ।’

“অনেকটা সেরকমই ।’

“কীভাবে মারা গেল?

“খুব কাছ থেকে গুলি খেয়েছে। এই সিঁড়ির নীচে পড়ে ছিল ।”

“জায়গাটা দেখব ।’

“নিশ্চয়, মসিয়ে ।’ একটামাত্র দড়ি দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে সিঁড়ির মুখ,
সেটা উচু করে ধরল পুলিশম্যান।
অস্পষ্ট রক্তের দাগ ছাড়া নীচে দেখার তেমন কিছু নেই। সিড়ি বেয়ে দু’পা- উঠতেই নাকে এসে ধাক্কা মারল তীব্র ঝাঝাল গন্ধ । নাক কুঁচকে দম নিতে নিতে সিঁড়ি বেয়ে উঠে লম্বা বারান্দা ধরে এগোল। দুই পাশে সারি সারি দরজা, এত বেশি ময়লা লেগে আছে, কতকাল পরিষ্কার করা হয়নি বোঝার উপায় নেই। হেটে চলল ও । মাঝেসাঝে একআধটা দরজার ওপাশে শোনা যাচ্ছে রেডিও কিংবা টেলিভিশনের শব্দ, আবার কোনও কোনওটার ভিতর থেকে ভেসে আসছে কথার
শব্দ । দুর্গন্ধ চিরস্থায়ী হয়ে ভেসে রয়েছে বাতাসে ।

এ কোন্‌ নরকে এলাম, ভাবছে থিয়াখি। এখানে যারা বাস করে, তাদের সবাই দরিদ্র ফরাসি কিংবা আলজিরিয়ান। জন্ত-জানোয়ারের মত থাকে । এই পৃথিবীর ওপর যেন কোন অধিকার নেই ওদের । এরকম একটা জায়গায় খুনখারাপিটা খুব সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু ডুক্সেম বিউরোর আকৃষ্ট হওয়ার কারণটা বুঝতে পারছে না ও । লাশটা দেখার পর হয়তো নিশ্চিত হতে পারবে ।

ঢোকার আগেই অন্ধকারে যতটা দেখা সম্ভব, বাড়িটা দেখে নিয়েছে ও । খুনী কোন পথে কোনদিক থেকে এসেছে বোঝার চেষ্টা করেছে।

ভিতরটাও দেখে নিয়ে | সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে সিগারেট ধরাল, দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলল ৷ পুলিশম্যানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার রাস্তা পেরিয়ে গাড়িতে উঠল । সিত্রোর ইঞ্জিন আগের মতই চলছে। দ্রাইভারকে বলল থিয়াখি, “মর্গে যাও ।’

বড় গাড়িটা ঘোরার সময় মুহূর্তের জন্য হেডলাইটের আলো পড়ল গ্রাউন্ড ফ্লোরের দরজার কাছে দাড়ানো একটা মূর্তির ওপর। লোকটার মাথার সামরিক বাহিনীর কেপি। সিত্রোটা রাস্তায় এগিয়ে অন্য গাড়ির সারিতে ঢুকে যেতেই নড়ে উঠল ও । যা দেখার দেখে নিয়েছে, আর কিছু নেই এখানে ।

মর্গে এসে অপেক্ষা করতে হলো থিয়াখিকে ৷ লাশ দেখানোর অনুমতি নিতে গেল অ্যাটেন্ডেন্ট । ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলল থিয়াখি। |

মুখটাকে নির্বিকার করে রেখেছে ড্রাইভার । ঘোৎ-ঘোৎ করে, ‘ঠিক আছে, মসিয়ে” বলে গাড়ির কাছে ফিরে গেল ।

সঙ্গে করে একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে নিয়ে এল আ্যাটেনডেন্ট। তিনি পাথোলজিস্ট, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, নিখুত করে ছাটা কালো গোঁফ। থিয়াখির সঙ্গে হাত মেলালেন । নিজের নাম জানালেন, দাস্তে

অ্যাটেন্ডেন্টের তালিকা দেখে ফ্রিজ ড্রয়ারের নম্বর মিলিয়ে নিলেন। তারপর ধাতব একটা মোটা হ্যাণ্ডেল দুই হাতে চেপে ধরে টেনে বের করলেন ভারি লম্বা ড্রয়ারটা।

এসব মুহুর্তে উত্তেজিত না হযে পারেনা থিয়াখি। লাশের দিকে তাকাল

ইতিমধ্যেই ধূসর হয়ে গেছে চামড়ার রঙ। বরফের মত ঠাণ্ডা শরীর। ভালমত পরিষ্কার করা হলেও বীভৎস দেখাচ্ছে মুখটা ।

আরও হাজার হাজার আ্যালজিরিয়ান তরুণের মতই শেষ পরিণতি হয়েছে করিম মোল্লারও । তবে এতটা খারাপ অবস্থা অনেকেরই হয় না।

মৃত্যুর কারণ? জিজ্ঞেস করল থিয়াখি।

“বুলেট । মুখের ভিতর পিস্তলের নল ঢুকিয়ে মগজে গুলি করা হয়েছে।’

“কিন্ত নাকের এই অবস্থা কেন?

প্রথমে নিশ্চয় পিটানো হয়েছে, দাস্তে জবাব দিলেন। ‘শুধু নাকই ভর্তা করেনি । ওর ডান হাতের দিকে তাকান ।’

করিমের মুঠোবদ্ধ ডান হাতটা ধরে উচু করল থিয়াখি। আঙুলের ফাঁকে এক টুকরো রক্তাক্ত মাংসখণ্ড বেরিয়ে থাকতে দেখল । “কী ওটা?

“ওর জিভ,’ দাস্তে বললেন ।

হাতটা নামিয়ে রাখল থিয়াখি। মারার পর ওরকম ক্ষতবিক্ষত করল কেন?
কোনও ধরনের সঙ্কেত কিংবা মেসেজ দিতে চেয়েছে?

‘মারার পর নয়, আগেই এসব করেছে, জ্যান্ত রেখে। প্রায়ার্স দিয়ে টেনে
ছিড়েছে জিভটা ।’

‘গড!’

‘এরকম কাণ্ড জীবনেও দেখিনি ।’

“দেখেননি?’ থিয়াখি বলল, ‘আমি দেখেছি। সেজন্যেই আমাকে দেখতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোথায় দেখেছি… কোথায়? যাই হোক, থ্যাংক ইউ, ডক্টর নিন, ঢুকিয়ে ফেলুন । আমি যাই । আমার আরও কাজ আছে ।’

গটগট করে করিডোর দিয়ে হেটে এল ও । বিল্ডিঙের লবি পেরিয়ে বেরিয়ে এল বাইরের বৃষ্টিতে ৷ গাড়িতে উঠে বলল, ‘জঘন্য ওই হট্টগোল বন্ধ করো। অফিসে নিয়ে চলো আমাকে ।

চুপচাপ হাত বাড়িয়ে রেডিওর সুইচ অফ করে দিল ড্রাইভার । থেমে গেল বাজনা । গিয়ার দিয়ে এত জোরে হুইল ঘোরাল, আরও একবার আর্তনাদ করে উঠল চাকার রাবার । ঘড়ি দেখল থিয়াখি ৷ রাত দুটো বেজে তিন মিনিট ।

রোববারের এক রোদ ঝলমলে সকালে, পোপের ভাষণ শোনার জন্য হাজার হাজার
তীর্থযাত্রী এসে জড় হয়েছে সেইন্ট পিটার্স স্কয়্যরে।

দুর্গের ওপরতলার একটা জানালার সামনে দাড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছেন পোপ। অলস ভঙ্গিতে ধর্মপ্রাণ খিস্টান শ্রোতাদের মাঝখানে কিছুক্ষণ ঘরে বেড়াল মাসুদ রানা, তারপর বেরিয়ে এল ওখান থেকে! ক্যাসল স্যান্ট আঞ্জোলোর পাশ দিয়ে
এসে টিবার পেরিয়ে ভিয়া জেনারডেলিতে পড়ল । এখানে একটা বারে কফি খেয়ে আবার নেমে এল রাস্তায় ।

অনেক দিন পর দীর্ঘ একটা ছুটি পেয়েছে ও । দুনিয়াময় ঘুরে বেড়াবে বলে ঠিক করেছে রানা । শুরু” করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপদেশ বার্বাডোস থেকে । একটা কটেজ ভাড়া নিয়েছিল। কয়েকটা দিন দারুন কেটেছিল ওখানে। দিনের বেশির ভাগ সময় সাগরে সাঁতার কেটে আর স্নারকেলিং করে কাটিয়েছে, সন্ধায় কটেজের চওড়া বরান্দায় বসে ডিনার খেয়েছে । চমৎকার রান্না করে বাড়ির মালিক মোটাসোটা প্রৌঢ়া মহিলা, বিশেষ করে সাগর থেকে তাজা ধরে আনা
মাছের গ্রিল। সেই সঙ্গে সরু চালের ভাত । তারপর বাড়িতে তৈরি আইসক্রিম । সবশেষে প্রচুর আম আর “পেপে, যত খুশি । ডাক্তার বলে দিয়েছেন উচ্ছৃঙখলতা একেবারেই চলবে না । মদ স্পর্শ করতে, রাত জাগতে নিষেধ করেছেন । তাই
ডিনার শেষে খানিকক্ষণ টেনিস খেলে রাত দশটা নাগাদ ঘুমের বড়ি খেয়ে একটা পেপারব্যাক বই নিয়ে বিছানায় গেছে ও।

কিছুদিন পর দ্বীপের জীবনে একঘেয়েমি আসায় প্লেনে চেপে বসেছে । মে’ র এক উষ্ণ বিকেলে প্রেন থেকে নেমেছে ফ্রান্সের দক্ষিণে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বন্দরনগরী মার্সেই-এ। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলেছে উপকূলের ভাল কোনও
হোটেলে নিয়ে যেতে যেখান থেকে ঘরে বসেই জেটিতে নোঙর করা জাহাজগুলো দেখা যায়।

কেউ যদি একা হয়, আর হাতে কোন কাজ না থাকে, প্রচুর দেখার সুযোগ থাকে। রানার বেলায়ও সেটাই হলো। সেদিন রাতে রাস্তার পাশে ডিনার খেতে বসে দুজন লোকের ওপর চোখ পড়ল ওর। কালো রঙের একটা হুডখোলা মার্সিডিজ ৩০০ডি ক্যাব্রিওলেতে করে এসেছে। এখানকার বাণিজ্যিক এলাকায় যেখানে প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রচুর লোক সমাগম হচ্ছে, সেখানেও কেমন যেন বেমানান এই দুজন মানুষ ।

ডকের কিনার ঘেঁষে থামল গাড়িটা । দুজনের মধ্যে খাটো লোকটা গাড়ি থেকে নামল। খাটো-হাতা বুশ শার্ট গায়ে, মাথায় ফরাসি সৌলজারদের মত কেপি। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপচাপ দাড়িয়ে সামনে নোঙর করা জাহাজগুলোকে
দেখল, তারপর পা বাড়াল একটা জাহাজের দিকে । গ্যাংওয়ে দিয়ে জাহাজে উঠে
ভিতরে চলে গেল।

লোকটার গাড়িতে বসা সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে আছে রানা । ওরই বয়েসী।……………………………

সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top