বই রিভিউ: “খাবারে বিষ, ওয়ার্নিং বেল, অবাক কাণ্ড -ভলিউম-১৮”
লেখক: রকিব হাসান
সিরিজ: তিন গোয়েন্দা
প্রকাশনী: সেবা প্রকাশনী
পর্যালোচনাঃ
“খাবারে বিষ, ওয়ার্নিং বেল, অবাক কাণ্ড” সিরিজের অষ্টাদশ ভলিউমটি বাংলা রহস্য-থ্রিলার সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল সংযোজন। দীর্ঘ সিরিজের ধারাবাহিকতায় এই বইটি পাঠককে নতুন করে চমকে দিয়েছে অপ্রত্যাশিত টুইস্ট, সমাজের অন্ধকার গলিপথে আলো ফেলার সাহস, এবং একগুচ্ছ চরিত্রের মাধ্যমে মানবিক সংকটের বহুমাত্রিক চিত্রায়নে। লেখকের গল্প বলার অনবদ্য দক্ষতা এবং বাস্তবতা ও কল্পনার মিশেলে তৈরি জটিল প্লট এই বইটিকে এক বসায় পড়ে ফেলার মত আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
কাহিনীর সংক্ষেপঃ
এই ভলিউমের কেন্দ্রে রয়েছে একটি খাদ্য বিষক্রিয়ার রহস্য, যা গোটা শহরকে আতঙ্কে ফেলে দেয়। একের পর এক হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, আর মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিচ্ছেন অনেকে। এই ঘটনার পিছনে কী শুধুই দুর্ঘটনা, নাকি কোনো সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র? প্রধান চরিত্র সঞ্জয় মিত্র, এক তরুণ সাংবাদিক, এই রহস্যের তদন্তে নামে। তার পথ চলায় যোগ হয় রহস্যমেয় “ওয়ার্নিং বেল”-এর ইঙ্গিত—একটি অজানা সোর্স থেকে আসা বার্তা, যা ভবিষ্যৎ বিপদকে আগাম জানান দেয়। কিন্তু এই ওয়ার্নিং বেলের উৎস কী? আর কেনইবা সঞ্জয় নিজেই এই খেলার অংশ হয়ে পড়ছে? গল্প এগোতে এগোতে সামনে আসে এক বৃহৎ কোম্পানির কালো কারবার, রাজনৈতিক যোগসাজশ, এবং মানুষের লোভের মুখোশ।
চরিত্রায়নঃ
সঞ্জয় মিত্রের চরিত্রটি এই সিরিজের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেও নতুন মাত্রা পেয়েছে। তার সততা, জেদ, এবং ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা পাঠককে তার প্রতি আকর্ষিত করে। অন্যদিকে, নতুন চরিত্র ডা. প্রিয়া সরকার, একজন মেডিকেল রিসার্চার, যিনি বিষক্রিয়ার নমুনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ভয়ঙ্কর সত্য আবিষ্কার করেন, তার উপস্থিতি কাহিনীতে বৈজ্ঞানিক যুক্তির ভারসাম্য এনেছে। খল চরিত্র হিসেবে কোম্পানির মালিক ঋত্বিক সেনগুপ্ত এবং তার দোসরদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব লেখক চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাদের লোভ, ক্ষমতার নেশা, এবং নৈতিকতার অবক্ষয় সমাজের আয়নায় এক করুণ প্রতিবিম্ব তৈরি করে।
শৈলী ও ভাষাঃ
লেখকের গদ্য দ্রুতগতির, রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি তৈরি করতে সক্ষম। সংলাপগুলো প্রাণবন্ত এবং চরিত্রদের ব্যক্তিত্বকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে। বিশেষ করে, খাদ্য বিষক্রিয়ার ঘটনাবলির বর্ণনায় এমন বাস্তবতা ফুটে উঠেছে যে পাঠক নিজের চারপাশেই যেন বিপদ টের পাবে। তবে কিছু জায়গায় একটু বেশি বর্ণনামূলক দৃশ্যায়ন প্লটের গতিকে খানিকটা থামিয়ে দিয়েছে। আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার এবং শহুরে জীবনের স্ল্যাং গল্পটিকে সমকালীন করে তুললেও কখনও কখনও তা প্রাকৃতিকতার ঘাটতি তৈরি করেছে।
থিম ও প্রতীকীতাঃ
এই বইয়ের মূল থিম হল “বিষ”—যা শুধু খাবারে নয়, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে। ক্ষমতার লোভ, নৈতিকতার মৃত্যু, এবং সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব—এই বিষগুলো লেখক প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। “ওয়ার্নিং বেল” হল সেই সতর্কবার্তা, যা আমরা প্রতিদিন উপেক্ষা করি, কিন্তু যখন বিপদ আসে, তখন বুঝতে পারি এর গুরুত্ব। অন্যদিকে, “অবাক কাণ্ড” শিরোনামটি ইঙ্গিত করে যে আমাদের চেনাজানা পৃথিবীতেই অদ্ভুতুড়ে ঘটনার জন্ম হয়, যার মূলে থাকে মানুষের হাত।
সমালোচনাঃ
দীর্ঘ সিরিজের এই ভলিউমটি নতুন পাঠকদের জন্য কিছুটা বিভ্রান্তিকর হতে পারে, কারণ পূর্ববর্তী ভলিউমগুলোর কিছু রেফারেন্স এখানে অনুল্লিখিত রয়ে গেছে। এছাড়া, ক্লাইম্যাক্সে ঋত্বিক সেনগুপ্তের পতন কিছুটা তাড়াহুড়োয় মনে হয়েছে, যা হয়তো আরও বিস্তারিত হওয়া উচিত ছিল। কিছু চরিত্র, যেমন পুলিশ অফিসার দেবজ্যোতি রায়, তাদের সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়নি।
উপসংহারঃ
“খাবারে বিষ, ওয়ার্নিং বেল, অবাক কাণ্ড – ভলিউম-১৮” বাংলা থ্রিলার সাহিত্যে একটি শক্তিশালী পদচারণা। এটি শুধু রোমাঞ্চ তৈরি করেনি, বরং সমাজের গলদকে নির্দেশ করে পাঠককে ভাবতে বাধ্য করেছে। লেখকের গল্প বলার টানটান উত্তেজনা এবং চরিত্রদের প্রতি সহমর্মিতা এই বইটিকে সিরিজের অন্যতম সেরা ভলিউম করে তুলেছে। যদিও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, তবুও রহস্য প্রেমী এবং সামাজিক ব্যঙ্গ খোঁজা পাঠকদের জন্য এটি অবশ্যপাঠ্য।
রেটিংঃ ৪.২/৫
আপনার কপি কিনুন রকমারি.কম থেকে–
এবং
বইটির ফ্রি সফট কপি ডাউনলোড করুন এখানে-