বই রিভিউ: “ওরিয়েন্টালিজম” – এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ
এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ-এর “ওরিয়েন্টালিজম” একটি ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ, যা পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিকোণ থেকে আরব, মুসলিম এবং এশীয় বিশ্বের প্রতি ধারণা এবং আচরণের ওপর আলোকপাত করে। বইটি সাঈদের জন্য একটি বিপ্লবী কাজ, যেখানে তিনি তুলে ধরেছেন কীভাবে পশ্চিমা সমাজ, শিক্ষা, সাহিত্য, এবং বিজ্ঞান মুসলিম বিশ্বের প্রতি বিকৃত ধারণা এবং পক্ষপাতিত্ব তৈরি করেছে, যা আজকের দিন পর্যন্ত বহমান।
বইয়ের পটভূমি: “ওরিয়েন্টালিজম” বইটি ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় এবং এটি আধুনিক ঔপনিবেশিকতা ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ। সাঈদ এখানে “ওরিয়েন্টালিজম” শব্দটি ব্যবহার করেছেন পশ্চিমা বিশ্বের ইসলাম, মুসলিম সমাজ, এবং এশিয়া সম্পর্কে যে ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক বৈষম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল, তা বোঝানোর জন্য। এই ধারণাটি এক ধরনের বৈষম্যমূলক এবং একতরফা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে, যার মাধ্যমে মুসলিম ও আরব বিশ্বের প্রতি পশ্চিমা সমাজের মনোভাব নেতিবাচক ও বিকৃত ছিল।
লেখকের বিশ্লেষণ: এডওয়ার্ড সাঈদ পশ্চিমা বিশ্বে এশিয়ান এবং মুসলিম জাতিগুলির প্রতি তৈরি করা একটি পুরনো “রূপকথা” বা “স্টেরিওটাইপ”কে উপস্থাপন করেন। তিনি দেখান, কীভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা, সাহিত্য এবং শিল্পকর্মের মাধ্যমে এই জাতিগুলোর প্রতি পক্ষপাতিত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা হয়েছে, যা এই জাতিগুলির সংস্কৃতি, ধর্ম এবং ইতিহাসকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে। সাঈদ তাঁর বইয়ে এই “ওরিয়েন্টালিজম” ধারণার ইতিহাসের উৎপত্তি, এর সমাজের ওপর প্রভাব এবং এর ফলস্বরূপ পশ্চিমা আধিপত্যের শোষণমূলক পদ্ধতিকে বিশ্লেষণ করেছেন।
মূল বিষয়বস্তু: বইটির মূল বক্তব্য হলো, পশ্চিমা সমাজের দীর্ঘদিনের “ওরিয়েন্টালিস্ট” দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মুসলিম, আরব, এবং এশিয়ান বিশ্বের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক অবস্থা বিকৃত হয়ে গেছে। সাঈদ এই ধারণাটিকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, যে কীভাবে পশ্চিমা ঐতিহ্য এবং চিন্তাভাবনা ইসলামের, আরবের, এবং মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি একতরফা দৃষ্টিকোণ তৈরি করেছে। সাঈদ এই বইয়ের মাধ্যমে আহ্বান জানিয়েছেন, যে পশ্চিমা বিশ্বের এ ধরনের বিভ্রান্তিকর ধারণার বিরুদ্ধে একটি ন্যায্য, সঠিক এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
মানবিক দৃষ্টিকোণ: এই বইটি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ নয়, এটি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাঈদ মুসলিম এবং আরব সমাজের প্রতি পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির বিকৃতি তুলে ধরে সেই জাতিগুলির মানবিক মর্যাদা এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বকে সঠিকভাবে চিত্রিত করার প্রয়োজনীয়তা জানিয়েছেন। তিনি ইঙ্গিত করেছেন, এ ধরনের বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গির ফলে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়নি, বরং বহু বছরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, এবং ধর্মীয় অঙ্গনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শেষ কথা: “ওরিয়েন্টালিজম” একটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সময়োপযোগী বই, যা পশ্চিমা সমাজের মুসলিম, আরব এবং এশীয় বিশ্বের প্রতি বিভ্রান্তি এবং ভুল ধারণাগুলির বিরুদ্ধে একটি গভীর প্রতিক্রিয়া। এটি পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন সমাজের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং এই বিভেদকে দূর করার জন্য সাঈদ একটি মানবিক এবং ন্যায্য দৃষ্টিকোণ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। এটি শুধু একাডেমিক গবেষণার জন্যই নয়, বরং যে কেউ পশ্চিমা সমাজের সমালোচনার ক্ষেত্রে একটি সম্যক দৃষ্টিভঙ্গি চায়, তাদের জন্যও অত্যন্ত মূল্যবান।
এটি শুধু সমাজতাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের জন্য নয়, বরং সাধারণ পাঠকদের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ, যারা সমাজের বৈষম্য এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকৃতির বিরুদ্ধে সচেতন হতে চান। “ওরিয়েন্টালিজম” পাঠকদের জন্য এক নতুন দৃষ্টিকোণ উন্মুক্ত করে, যা তাদের নিজেদের মধ্যে বৈষম্য, জাতিগত বিভেদ এবং সাংস্কৃতিক অসম্মানকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য এক শক্তিশালী উৎসাহ জোগাবে।
আপনার কপি কিনুন রকমারি.কম থেকে–
এবং
বইটির ফ্রি সফট কপি ডাউনলোড করুন এখানে-