Andalusiar Shomudro Shoikote by Enayetullah Altamash

আন্দালুসিয়ার সমুদ্রসৈকতে – এনায়েতুল্লাহ আলতামাশ (Andalusiar Shomudro Shoikote by Enayetullah Altamash)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

০১.

৯৭ হিজরী মোতাবেক ৭১৫ খ্রিস্টাব্দের কথা। প্রতি বছরের মতো এ বছরও হজ্জের মৌসুমে মক্কা শরীফে বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম ঘটেছে। শহর ও শহরের আশপাশে, অলিগলিতে, রাস্তাঘাটে হাটবাজারে সর্বত্রই শুধু মানুষ, আর মানুষ। যেন সুদূর বিস্তৃত উপচে পড়া এক জনসমুদ্র।

এই বিশাল জনসমুদ্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, তাঁদের সকলের লেবাস এক। ডান বগলের নিচ দিয়ে বাম কাঁধের উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে টাখনু পর্যন্ত নেমে আসা সফেদ চাদর। মুণ্ডানো মাথা, আর নাঙ্গা পা। তাঁদের সকলের দৃষ্টির লক্ষ্যস্থল, আর আশা-আকাক্ষার কেন্দ্রবিন্দু এক। তাদের অন্তর, আর অন্তরলোকের দীপাধার একমাত্র খানায়ে কাবা।

তাঁদের লেবাস যেমন এক, তেমনি তাদের চিন্তা-চেতনা ও ধর্মবিশ্বাসও এক। তাঁদের মুখে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর গুঞ্জন-ধ্বনি, আর বুকে ঈমান সংরক্ষণের শপথবাণী। তাঁরা সকলেই হলেন হাজি। হজ্জ আদায়ের উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছেন।

গোটা মক্কা শহর ছোট বড় তাবুতে ভরে গেছে। তাবুতে ঘেরা এই ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় নারী-পুরুষ আছেন, ছোট ছোট ছেলে-মেয়েও আছে।

এই বিপুল জনসমুদ্রের লেবাস এক। কিন্তু গায়ের রং ভিন্ন। তাদের মাঝে গৌরবর্ণের মানুষ যেমন আছে, তেমনি চাঁদহীন অন্ধকার রাতের ন্যায় কালো চেহারার মানুষও আছে। বাদামী রং-এর মানুষ যেমন আছে, তেমনি গোলাপী চেহারার মানুষও আছে। আছে কমজোর ও দুর্বল মানুষ। সিপাহী আছে, আছেন সিপাহসালার। মনিব আছেন, আছে গোলামও।

মনে হচ্ছে, সকলেই যেন একই গোত্রের মানুষ। তাদের চাল-চলন এক। স্বরবে ও নীরবে তারা এক। তাঁদের বাচনভঙ্গি এক। তারা কোন এক মুলুক থেকে আসেননি; এসেছেন বিভিন্ন মুলুক থেকে। তাদের মধ্যে কেউ এসেছেন আফ্রিকা। থেকে, কেউ আবার চীন থেকে। কেউ এসেছেন ইরান থেকে, কেউ আবার তুরান, থেকে। মোটকথা, যেখানেই ইসলামের নূর পৌঁছেছে, ঈমানের আলো ফুটেছে সেখান থেকেই মুসলমানগণ হজ্জ উপলক্ষে মক্কা শরীফ চলে এসেছেন।

তারা একজন অন্যজনের ভাষা বুঝেন না, কিন্তু তাদের সকলের হৃদয় একই সুতার বাঁধনে বাঁধা। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে হৃদয় দিয়ে অনুভব করছেন। একজনের আবাস-ভূমি অন্যজনের আবাস ভূমি থেকে যোজন যোজন মাইল দূর, কিন্তু তাদের হৃদয়-ভূমির মাঝে নেই কোন দূরত্ব। সকলের মাঝেই এমন সজ্জনভাব যে, কেউ কাউকে আজনবী মনে করেন না। মনে করেন না পরদেশী।

সফেদ এহরাম পরিহিত এই বিশাল জনসমুদ্রের সকলের অনুভূতিও সফেদ। তাদের অবচেতন মনের অনুভূতি হল–এটাই তাদের প্রিয় ভূমি। এটাই তাদের জীবন-সফরের আখেরী মনযিল। আস্থা ও বিশ্বাসের পবিত্র অনুভূতি তাদের চেহারায় এক অভূতপূর্ব উজ্বল্য এনে দিয়েছে।

মক্কা শরীফের আকাশে-বাতাসে মৃদুমন্দ ছন্দে সুরের ঝঙ্কার তুলে সকলের মুখ থেকে বের হয়ে আসছে :

“লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নালহামদা ওয়াননে’মাতা লাকা ওয়ালমুল লা-শারিকা লাক্।”

মোহনীয় এই পবিত্র সুরের মূর্ঘনায় চতুর্দিকে এক নৈসর্গিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। রাজা-বাদশাহদের গর্ভিত মস্তকও বিনয়াবনত হয়ে পড়ছে। হৃদয়ের তন্ত্রিতে তন্ত্রিতে আল্লাহ প্রেমের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভাষা-বর্ণ, উঁচু-নীচুর বিভেদ ভুলে সকলেই যেন আল্লাহর রঙ্গে নিজেকে রাঙ্গিয়ে তুলছে।

হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতে এখনও কয়েকদিন বাকি। দূরদরাজ থেকে এখনও হাজিগণ আসছেন। বিস্তৃত প্রান্তর জোড়ে তাঁবুর বসতি গড়ে উঠছে। দিন দিন উট আর দুম্বার আওয়াজ বেড়ে চলছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top