একটু চোখ বুলিয়ে নিন
১
উল্টে-পাল্টে কাগজটা আহমদ মুসা বার বার পড়ল। না পরিষ্কার লেখা। লেখায় বিন্দুমাত্র দ্ব্যর্থবোধকতা নেই। ‘১৩১-এর সি, রূয়ে আনাতলে ডেলা ফর্গ’-স্পষ্টাক্ষরে লেখা। কিন্তু এই নাম্বারে কোন বাড়ি নেই।
গতকাল দু’বার এসে সে তন্ন তন্ন করে খুঁজে গেছে। খোঁজায় কোন ফাঁক রাখেনি। কিন্তু বাড়িটা পাওয়া যায়নি। একশ’ একত্রিশ-এর এ,বি,সি, কিছুই নেই।
কিন্তু মন তার মানছে না। পরাজয় স্বীকার করে নিতে রাজি হচ্ছে না তার মন।
গতকাল দু’বারই দিনের বেলা খুঁজেছে। আর রাতে খুঁজবে মনে করে রুয়ে আনাতলে রোডের সেই নির্দিষ্ট স্থানে এসে নামল আহমদ মুসা ট্যাক্সি থেকে। রাত তখন ৯টা।
ঠিকানার সন্ধানে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরির পর আহমদ মুসা ঠিক করল লোকদের আজকে সে জিজ্ঞেস করবে। ১৩১নং বাড়িতে গিয়ে নক করল আহমদ মুসা। মুহূর্ত কয়েক পরে দরজা খোলার শব্দ হলো। দরজা অল্প ফাঁক করে একটা মুখ বলল, ‘কি সহযোগিতা করতে পারি আপনাকে। কাকে চাই আপনার?’
‘আমি একজন বিদেশী। ‘১৩১-এর সি’ বাসাটা আমি খুঁজছি। দয়া করে সাহায্য করতে পারেন?’ বিনীতভাবে বলল আহমদ মুসা।
দরজাটা এবার খুলে গেল।
একজন তরুণী খোলা দরজায় এসে দাঁড়াল। বলল, ‘নাম্বারটা আপনি কোথায় পেলেন?’
‘নাম্বারটির মালিক যিনি তারই লেখা ঠিকানা থেকে তুলে নিয়েছি’।
‘যাই হোক, আপনার ভুল হয়েছে। এ ধরণের কোন নাম্বার এ রাস্তায় নেই। এ রাস্তায় কোন নাম্বারের সাথেই এ,বি,সি ইত্যাদি ধরণের কোন কিছুর সংযোজন নেই।’
আহমদ মুসা ভাবছিল। মেয়েটির কথার জবাবে কিছু বলল না।
‘আপনার অসুবিধার জন্যে দুঃখিত। ওকে’। বলে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল মেয়েটি। আহমদ মুসা বলল, ‘দয়া করে কি বলবেন, আপনার আব্বার নাম কি?’
মেয়েটির মুখ মুহুর্তের জন্যে মলিন দেখা গেল। তারপরই হেসে উঠে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি আপনি জানতে চাচ্ছেন এ বাড়িটাই আপনার বাঞ্ছিত বাড়ি কিনা। না তা নয়। আমি ও আমার আম্মা ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ থাকেন না’।
‘ধন্যবাদ’ বলে আহমদ মুসা সরে এল তাদের বাড়ির গেট থেকে। পিতার নাম জিজ্ঞেস করায় মেয়েটির মুখ মলিন হওয়া থেকে আহমদ মুসা বুঝল, তার আব্বা নেই। ওরা ‘সিংগল’ প্যারেন্ট ফ্যামেলি। এমন বিয়ে বহির্ভূত মা ও সন্তানের সিংগল ফ্যামিলি এখন পাশ্চাত্যে হাজার হাজার। কিন্তু বিরাট এক দুর্ভিক্ষ তাদের মনে। মেয়েটির ম্লান মুখে দেখা গেছে তারই একটা প্রতিচ্ছবি।
রাস্তায় নেমে এল আহমদ মুসা। কিন্তু কোথায় যাবে সে!
আহমদ মুসা শিথিল পায়ে আনমনে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। ডুপ্লের ঠিকানা নিয়েই সে ভাবছে। তার মন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে, মি. ফ্রাংক তাকে ভুল ঠিকানা দিয়েছে কিংবা ডুপ্লে ভুল ঠিকানা লিখেছে। কিন্তু সে নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছে ১৩১-এর সাথে কোন এ,বি,সি নেই এবং মেয়েটিও তাই বলল। তাহলে?
ঠিকানা লেখা কাগজটির ওপর আবার নজর বুলাল আহমদ মুসা। দেখল, ১৩১-এর ‘সি’ লিখে তার পাশে আবার ‘+’ চিহ্ন দেয়া আছে। চমকে উঠল আহমদ মুসা। এখানে ‘+’ চিহ্ন কেন? এর অর্থ কি এই যে, ১৩১ থেকে ‘প্লাস’ অর্থাৎ সামনের দিকে ‘সি’ অর্থাৎ তিন নাম্বার বাড়িটাই ডুপ্লের হবে? সংকেতে কি এটাই বুঝাতে চেয়েছে?
আহমদ মুসা মুখ তুলে দেখল। সে যে বাড়ির সামনে এসে দাড়িয়েছে, সেই বাড়িটিই ১৩১-এর পর তিন নাম্বার বাড়ি। তাহলে এখানেই কি ডুপ্লে থাকেন?
কিন্তু আবার ভাবল, ডুপ্লে ঠিকানা এভাবে লিখবে কেন? না, এখানে ঠিকানা লেখার এরকম একটা প্রচলন আছে, যা অনেকেই ইচ্ছা হলে লিখে থাকে।
হঠাৎ একাধিক নারী কন্ঠের চাপা চিৎকারে আহমদ মুসা চমকে উঠল। আহমদ মুসা যাকে ডুপ্লের বাড়ি বলে ভাবছে, সেখান থেকেই এই চিৎকার আসছে। ধ্বস্তাধ্বস্তির একটা শব্দও কানে আসছে আহমদ মুসার।
রাস্তা থেকে ছুটল আহমদ মুসা বাড়িটার দিকে।
বাড়ির সামনে দু’টো গাড়ি দাড়িয়ে আছে। একটা সাধারণ মাইক্রোবাস, আরেকটা অত্যন্ত দামী গাড়ি।
আহমদ মুসা গাড়ি বারান্দা পার হয়ে লাফ দিয়ে বারান্দায় গিয়ে উঠল। সামনেই একটা দরজা। সম্ভবত বাড়ির ড্রইং রুম। ধ্বস্তাধ্বস্তি থেমে গেছে। ভয়ার্ত নারী কন্ঠ এবার চিৎকারের বদলে কেঁদে কেঁদে জীবন ভিক্ষার জন্যে অনুনয়-বিনয় করছে।
আহমদ মুসা দরজায় মৃদু চাপ দিল। দরজা নড়ে উঠল। খুশি হলো আহমদ মুসা, দরজা খোলা আছে দেখে। দরজা ঠেলে কৌতুহলী আগন্তুকের মত ঘরে প্রবেশ করল আহমদ মুসা। যখন আহমদ মুসা ঘরের ভেতর পা রাখল, তখন একটি কন্ঠ চিৎকার করে বলছে, ‘শোরগোল না থামালে তোমাদেরও বেঁধে নিয়ে যাব আমরা। তাতে আমাদের মজাই হবে। আহমদ মুসা দেখতে পেল, একজনের পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ে একজন মহিলা কাঁদছে। পাশেই আরেকটি তরুণী গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে। এদেরকে লক্ষ্য করেই ঐ কন্ঠটি চিৎকার করে উঠেছিল। আর আহমদ মুসা, তার সামনেই দেখতে পেল হাত-পা বাঁধা একজন লোককে দু’জন লোক নিয়ে আসছে। একজন ধরেছে দুই পা, আরেকজন হাত।