একটু চোখ বুলিয়ে নিন
সাতানব্বই হিজরী। সাত শ পনের খৃষ্টাব্দ। মক্কা নগরীতে মানুষের ভিড় উপচে পড়ছে, কোথাও তিল ধারনের ঠাই নেই। শহর-বন্দর, হাট-বাজার সর্বত্র মানুষ আর মানুষ। এ উদ্বেলিত ভিড়ের একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাদের সকলের পোষাক-পরিচ্ছদ এক। কাঁধ হতে টাখনু পর্যন্ত সাদা চাদরে আবৃত। এক স্কন্ধ, মাথা ও পদযুগল উন্মুক্ত। তাদের চিন্তা-ফিকির, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, অন্তর ও মনের মারকাজ এক, তাহলে খানায়ে কাবা।
যেমনিভাবে তাদের পোশাক-আষাক এক, তেমনিভাবে তাদের চিন্তা-চেতনা, ধর্ম বিশ্বাসও এক। লা-ইলাহা ইল্লাল্ লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্। তারা সবাই মুসলিম। তারা হারাম শরীফ আবাদকারী। তারা হাজী, হজ্জের ফরজ আদায় করতে সমবেত হয়েছে।
মক্কা নগরীর অদূরে গড়ে উঠেছে, ভাবুর এক ঘন পল্লী। সে পল্লীতে রয়েছে। নারী-পুরুষ এমন কি শিশু-কিশোররাও।
তাদের সকলের পরিচ্ছদ এক কিন্তু গায়ের রং ভিন্ন। কেউ ফর্সা, কেউ নিকষ কালো। কেউ গোরা আবার কেউ ধলা। তাদের মাঝে যেমন রয়েছে প্রভাব। প্রতিপত্তিশালী তেমনি রয়েছে দুর্বল-হীন। যেমনি রয়েছে সিপাহসালার তেমনি আছে মামুলী সৈনিক। আছে মুনিব, আছে গোলাম। এ ভেদাভেদ থাকার পরেও মনে, হচ্ছিল তারা সকলে এক অভিন্ন, একই রংগে রঞ্জিত। তাদের সকলের চলা-ফেরা, কথা-ঝর্তার ধরন এক।
তারা কোন এক দেশের বাসিন্দা নয়। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত। তাদের মাঝে রয়েছে আফ্রিকী, চীনী, হিন্দুস্তানী, ইরানী মোটকথা যেখানে ইসলামের জ্যোতি পৌঁছেছে, সেথা হতে মুসলিম উম্মাহ্ একত্রিত হয়েছে পবিত্র মক্কা নগরীতে।
তারা একে অপরের মুখের ভাষা অনুধাবন করতে পারছিল না কিন্তু অন্তরের কথা ভাল করেই অনুভব করতেছিল। হাজার হাজার ক্রোশ দূরে বসবাসকারীদের হৃদয় মন ছিল একই সূতিকায় গ্রোথিত। কারো অন্তরে ছিলনা বিন্দুপরিমাণ বিভেদ। সকলের মাঝে ছিল সুনিবীড় সম্পর্ক। কেউ নিজেকে একাকী মনে করছিল না। ইহরামের সাদা কাপড় পরিহিত প্রতিটি ব্যক্তিই মনে করছিল যেন সে এখানেই জন্মেছে এবং জীবন তরীর সফর এ মঞ্জিলেই শেষ হবে।
অগাধ ভক্তি ও শ্রদ্ধা সকলের মাঝে এক অপার্থিব অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। পূণ্যভূমি মক্কা নগরীতে সৃষ্টি হয়েছিল অবিরাম গুঞ্জন। সবার মুখে অনুরিত হচ্ছিল ‘তালবিয়া”,
লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা-শারীকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নি’মাতা লাকাওয়াল মুলক, লা-শারীকালাক। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাদশাহ আমীর, ধনী-গরীব সকলের শির হচ্ছিল নত। মুখের অনুরিত ধ্বনিতে অন্তরের অবস্থা পরিবর্তন হচ্ছিল। বংশ গৌরব ও শরীরের রং-এর পার্থক্য না করে সকলে হচ্ছিল আল্লাহর রঙ্গে রঞ্জিত।
হজ্জের এখনও বেশ কিছুদিন বাকী। দূর-দূরান্ত থেকে এখনো কাফেলা আসছে। তাবুর সংখ্যা বাড়ছে। উট ও দুম্বার আওয়াজ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ ভিড়ের মাঝে কিছু লোক এখানে-সেখানে হাত পেতে বসেআছে। কারো কারো সামনে রয়েছে কাপড় বিছান, আবার অনেকের হাতে রয়েছে ঝুলি। এরা ভিখারী। তাদের কিছু সংখ্যক শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধি, তবে বেশীর ভাগই মরুভূমিতে বসবাসকারী গ্রম্য। হজ্জের মৌসুমে তারা মক্কায় এসে ভিক্ষা করে বেশ টাকা-পয়সা উপার্জন করে নিয়ে যায়।
হাজীরা তাদেরকে দান করেন। তাদের মাঝে কে ভিক্ষার উপযুক্ত আর কে উপযুক্ত না সেদিকে তারা লক্ষ্য করেন না। তারাতো আল্লাহর রাস্তায় দান করেন। এ ভিখারীদেরকে দান করা হজ্জের অবশ্যপালনীয় কাজের একটা অংশ হিসেবে তারা জ্ঞান করেন।
ঐসব ভিখারীদের মাঝে আরো একজন ভিখারী এসে শামিল হয়েছিল যা কোন হাজী লক্ষ্য করেননি। লক্ষ্য করারই বা কি প্রয়োজন, অন্যান্য ভিক্ষুকদের মত সেও একজন ভিক্ষুক। এ নতুন ভিক্ষুকের মাঝে বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য নেই। জীর্ণ-শীর্ণ বস্ত্র, হাতে-পায়ে ময়লা, দাড়িতে জমে রয়েছে ধূলাবালু, তার মাঝে যদি বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য থেকে থাকে তাহলে তা হলো সে অতিবৃদ্ধ ও ভীষণ দূর্বল, বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম নয়।
তার মাঝে আরেকটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল; যদ্বরুন মানুষ গভীরভাবে তাকে লক্ষ্য করছিল- তাহলো তার পায়ে শিকল, বুঝা যাচ্ছিল সে কয়েদী, বিশেষ অনুগ্রহ করে তাকে ভিক্ষার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
তুমি কি কয়েদী? প্রথম দিনই একহাজী তাকে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, সে মাথা নেড়ে জবাব দিয়েছিল। তার চোখ দুটো ছিল-অশ্রুসজল।
“চুরি করেছ?”
“যদি চুরি করতাম তাহলে হাত কাটা থাকত। সে তার কম্পমান হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে জবাব দিল।
“কোন মহিলার সাথে জিনায় লিপ্ত হয়েছিলে?”