একটু চোখ বুলিয়ে নিন
বাঘের মত চেহারা, শোনা যায় কেউ নাকি কখনও তাকে হাসতে দেখেনি; তিনিই সবার আগে এলেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির চীফ কর্নেল হেমায়েত হায়দার । বিসিআই ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সিকে অনেক ক্ষেত্রে প্রায় একই ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়, তাই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে খানিকটা রেষারেষি ও প্রতিদ্বন্বিতার ভাব আছে। বিসিআই-এর অন্যতম সেরা এজেন্টের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার সময় কর্নেল যদি একটু বেশি চাপ দিয়ে থাকেন, মেজবান হিসেবে রানার উচিত হবে বুঝতে না পারার ‘ভান করা। রানা করলও তাই, তবে হাসিটা দেখাল অনেকটা কান্নার মত। হাত ছেড়ে দিয়ে রানার কাধ চাপড়ে দিলেন কর্নেল হেমায়েত হায়দার, ব্রাভো, মাই সান! আমরা সবাই তোমাকে নিয়ে ঠার্বিত।’ প্রশংসা করলেন, অথচ ভঙ্গিটা মারমুখো, গর্বিত হতে না পারলেই যেন ভাল হত। রানাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইলোরার পিছু নিয়ে চলে গেলেন তিনি
মেজর জেনারেল রাহাত খানের চেম্বারের দিকে।
এর পাঁচ মিনিট পর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে এলেন জেনারেল চৌধুরী আশরাফুজ্জামান, মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স-এর চীফ। বাহুল্যবর্জিত তালগাছ বলা চলে; ঠোটের দু’পাশে এমন সব রেখা আর ভাজ আছে, দেখে মনে হয় সারাক্ষণ হাসছেন। কিন্তু চোখ দুটো স্থির। একেই বোধহয় পাথুরে চোখ বলে, মণি নড়লেও টের পাওয়া যায় না। রানাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেন তিনি। ‘পথ দেখাও, বলে চলে গেলেন ইলোরার সঙ্গে।
জেনারেলের কাণ্ড দেখে মনে মনে হাসল রানা । কত রকম অভিমানই না থাকে মানুষের! ট্রেনিং পিরিয়ডে, পরেও, মিলিটারী ইন্টেলিজেন্সে রানার কমান্ডিং অফিসার ছিলেন চৌধুরী আশরাফুজ্জামান । অত্যন্ত স্নেহ করতেন ওকে, ব্যক্তিগত আলাপের সময় প্রায়ই ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, “তোমার মত অফিসাররাই সিঁড়ির শেষ ধাপ পর্যন্ত পৌছতে পারে, রানা । আমি চোখ বুজলে পরিষ্কার দেখতে পাই, একদিন তুমি চীফ অভ আর্মি স্টাফ হয়েছ।’ সেই রানা হঠাৎ করে সেনাবাহিনী থেকে বেরিয়ে আসায় ব্যক্তিগতভারে খুব বড় আঘাত পান তিনি । রানার প্রতি তার সেই সন্দেহ এখনও নিশ্চয় আছে, অভিমানের বহর দেখেই সেটা আন্দাজ করা যায়। শোনা যায়, একে-ওকে জিজ্ঞেস করে রানার সব খবরই রাখেন তিনি, কিন্তু কথা বলেন না ওর সঙ্গে। যদিও প্রতিবছর তার জন্মদিনে রানার পাঠানো উপহার আজ পর্যস্ত ফিরে আসেনি কখনও । ইনি আসছেন বলেই কি ওকে আজ অভ্যর্থনায় উপস্থিত থাকতে বলেছেন রাহাত খান? এখানেও রেষারেষি- দুই বুড়োর মধ্যে?
জেনারেলের সঙ্গে আরও দুই জ্দ্রলোক এসেছেন । প্রথমজন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহিন সাযযাদ, দ্বিতীয়জন বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ইলিয়াস আহমেদ ।
সবশেষে এলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবকে সঙ্গে নিয়ে স্বয়ং মন্ত্রী মহোদয় ।
কাজ শেষ, নিজের অফিস কামরায় অস্থির পায়ে পায়চারি করছে রানা। অঙ্কটা কোনভাবেই মেলাতে পারছে না। মাঝে মাঝে কটমর্ট করে চাইছে কাজে ব্যস্ত ওর হাসিখুশি, সুন্দরী সেক্রেটারী কাকলির দিকে। ইলোরার সঙ্গে জবর ভাব মেয়েটার, নিশ্চয় জানে ছয়তলার ওই ঘরটায় এত লোকের সমাগম কিসের জন্যে কিন্তু মুখ খুলছে না কিছুতেই । তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করায় হতাশ ভঙ্গি করে” বলেছে, “দেখো, মাসুদ ভাই, মাথাটা একটু খাটাও। সত্যিই যদি-গুরুতৃপূর্ণ কিছু ঘটে থাকে সেটা আমার বা ইলোরার চেয়ে তোমারই তো আগে জানার কর্থা। তুমি তো আমাকে কিছু জানাওনি, আমি জানব কি করে? আমি শুধু শুনেছি গতরাতে বাড়ি যাননি চীফ, সোহেল সাহেবও না।’
অ্যাঁ? এতবড় একটা খবর, পাজি মেয়ে বেমালুম চেপে রেখেছ পেটের মধ্যে! আগে বলোনি কেন, সোহেলকে ঠেসে ধরে মুখ খুলিয়ে ছাড়তাম।’
ইন্টারকমের দিকে হাত বাড়াল রানা । তাই দেখে মৃদু হাসল কাকলি । “তাকে পেলে তো! তিনিও তো স্যারের সঙ্গে । কফি কর্ণারের দিকে ইঙ্গিত করল চোখ দিয়ে, তারচেয়ে – একটু সুস্থির হয়ে বসো, আমি কফি করে আনছি। জরুরী ব্যাপার যখন, নিশ্চয়ই ডাকা হবে তোমাকে ।’
“কফি? হ্যা, হ্যা, লাইন পাওয়া গেছে। নিশ্চয়ই বুড়োর ঘরে বার কয়েক কফি নিয়ে গেছে বুড়িটা?
বুড়ি আবার পেলে কোথায়?
“ওই তোমার বান্ধবী…ইলোরা ।’
‘পঁচিশ বছর বয়সেই ও বুড়ি হয়ে গেল কি করে?
‘তুমি লক্ষ করোনি? আশ্চর্য! খেয়াল করোনি আমাকে না পেয়ে কেমন বুড়িয়ে মত যাচ্ছে মেয়েটা?
হা-হা করে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠল কাকলি ।
“আরে, এতে হাসির কি আছে! বিশ্বাস হচ্ছে না? ওকে জিজ্ঞেস করে দেখো কথাটা হানড্রেড পার্সেন্ট সত্যি কি না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয় না।
‘পাগল!’ বলে কফি কর্নারের দিকে এগোল কাকলি । “কি জিজ্ঞেস করেছিলে ওকে?
“জিজ্ঞেস করেছিলাম সোহেল কোথাঘ গেছে। বলল, জানে না।
‘ঠিকই তো বলেছে,’ জোরের সঙ্গে বলল কাকলি, “অফিশিয়াল সিক্রেট আউট করবে কেন?
“তাহলে তোমাকে বলল কি করে? এতে সিক্রেট আউট হলো না? মধুর হাসি হাসল রানা । “মানেটা কি? আমি ওর চোখের মণি, কলজের টুকরো-সেই আমাকেই বলছে না, অথচ তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দীকে ভ্যাড়ভ্যাড় করে বলে ফেলছে সব সিক্রেট!’
“কে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দী? আমি?’
“তবে আর কে? আবার হা-হা করে হেসে উঠল মেয়েটা
রানাও হাসছে । বলল, “হাসো । রানার্স-আপ হয়েছ জেনে খুব খুশি লাগছে, না? যাক, কাজের কথায় আসা যাক। তুমি বলছ, সারারাত বসের সঙ্গে মীটিং করেছে সোহেল, কি নিয়ে মীটিং তা নিশ্চয়ই বলেছে ইলোরা ডাইনী?
দুইহাতে দু’কাপ কফি নিয়ে দ্রুতপায়ে এদিকে আসছিল কাকলি, থমকে দীড়াল। হাসি সামলে নিয়ে নিজের টেবিলে নামিয়ে রাখল একটা কাপ, রানার সামনে রাখল অপরটি | তারপর দুইহাত কোমরে রেখে বলল, “কী অস্থির লোকরে, বাবা! একটু পরেই ডাকবে বস্, তাও তর সইছে না।’
“আসলে কাজটা পাচ্ছি, না ফসকে যাবে, সেটা জানতে ইচ্ছে করে না মানুষের?
“আমার করে না। তোমাদের কাজ মানেই তো চোখ বন্ধ করে বিপদ আর মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়া । এমন কাজ ফসকে গেলেই বরং খুশি হই আমি। তোমার মত গুপ্তা প্রকৃতির বেপরোয়া লোকের হয়তো জানতে ইচ্ছে করে। এখন বলো দেখি, দুষ্ট বালক, ঠিক কি জানতে চাও?’
‘আপামণি, আমি জানতে চাই, কফি নিয়ে গিয়ে ভেতরে কি দেখেছে ইলোরা ।’
‘তেমন কিছুই না। কখনও দেখেছে গভীর আলাপে মত্ত দুজন, কখনও টেলিফোনে কথা বলছে বাইরের কারও সঙ্গে, শেষবার দেখেছে দুজন মিলে টিভিতে একটা ফিল্ম দেখছিল ।’
অ্যাঁ? লাফিয়ে উঠে দীড়াল রানা । “বলো কি! সোহেলকে নিয়ে ব্লু ফিল্ম দেখছে বুড়ো?
“এরমধ্যে আবার ব্লু ফিল্ম পেলে কোথায়?
“সারারাত জেগে ছবি দেখলে আর কি ছবি দেখে মানুষ? বলেই আবার পায়চারি শুরু করল রানা ।
“কফির কি হবে?’
‘ওহ্-হো!’ বলে কাপটা তুলেই বড় করে চুমুক দিল রানা, পরমুহূর্তে আর্তনাদ করে উঠল । পুড়ে গেছে জিভ।
পানি আনবে না কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না কাকলি, এমনি সময় ইন্টারকমে ভেসে এলো ইলোরার কণ্ঠস্বর ।
রানা?
মুহূর্তে হাসি ফুটল রানার মুখে । নরম গলায় বলল, হ্যা, রানী! এতদিন যা বলবে বলবে করেও বলতে পারছিলে না, সেই কথাটা তো? নাও, বলে ফেলো-শুনছি।’
“মেজর জেনারেল লাইনে আছেন, কথা বলো ।
আধহাত জিভ বেরিয়ে পড়ল রানার । কামড়ে ধরে আছে। নিঃশব্দে হাসছে কাকলি, এক আঙুল তুলে ভঙ্গি করে বোঝাচ্ছে, ঠিক হয়েছে! কানে রিসিভার ধরে মূর্তির মত দাড়িয়ে থাকল রানা-জবান বন্ধ ।
“রানা? রাহাত খানের জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে রানার বুকের রক্ত ছলকে উঠল । “এখুনি আমার চেম্বারে চলে এসো ।’
“ইয়েস; স্যার!’ রানাকে কামরায় ছুকতে দেখে অপমানজনক ভঙ্গিতে মুচকি হাসল ইলোরা। “কেমন জব্দ? আমার সঙ্গে লাগতে “আসবে আর? যাও, সোজা ঢুকে পড়ো, বস্. অপেক্ষা করছেন ।’
‘এই মুহূর্তে রানা অন্য এক মানুষ, ইলোরার কথা ভাল করে শুনতেই পেল না। মন থেকে উদ্বেগ আর উত্তেজনা ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। মাথাটাকেও পরিষ্কার আর খালি করে রেখেছে। বস্ নিশ্চয়ই কোন বিপদের কথা শোনাবেন, দেশের জন্যে গুরুতর কোন সমস্যা ব্যাখ্যা করবেন। সেই বিপদ আর সমস্যার গভীরে ঢোকার জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি হয়েই ভেতরে ঢুকছে রানা ।
দুই
রাহাত খানের চোখে-মুখে আশ্চর্য এক দৃঢ়তা, ভেতরে ঢুকে এটাই প্রথমে ‘লক্ষ করল রানা। রাত্রি জাগরণের কোন চিহই নেই, শুধু একটু লালচে হয়ে আছে চোখ দুটো-যেন ধিকিধিকি জ্বলছে ছাইচাপা দু্টুকরো অঙ্গার। বসে আছেন রিভলভিং চেয়ারে, শিরদাড়া খাড়া। হাতের চুরুট থেকে ধোয়া উঠছে। চেম্বারে একা তিনি, কখন কে জানে বেরিয়ে গেছে সোহেল ।
বসো, বললেন তিনি, সরাসরি রানার দিকে থাকিয়ে আছেন।
হাতলবিহীন একটা চেয়ার টেনে বসল রানা । খুঁটিয়ে না দেখেও বুঝতে পারছে অতিথিরা চলে যাবার পর কামরা ও ডেস্ক পরিষ্কার করা হয়েছে। এসি কোন শব্দ করছে না, ঠাণ্ডা বাতাস ভারি হয়ে আছে হাভানা চুরুটেন্ কড়া, মিষ্টি গন্ধে ।
চেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে বসো, রানাকে অবাক করে দিয়ে বললেন রাহাত খান। “ভিডিও ক্যাসেটে রেকর্ড করা একটা ডকুমেন্টারি দেখাই তোমাকে ।’ ডেস্ক থেকে একটা রিমোট কন্ট্রোল তুললেন তিনি, তাকিয়ে আছেন কামরার এক কোণে, ওদিকে ট্রলির ওপর একটা একুশ ইঞ্চি কালার টিভি ও একটা ভিসিআর রয়েছে।
চেয়ারটা একটু ঘুরিয়ে, বসের দিকে খানিকটা পাশ ফিরে বসল রানা । রিমোট কন্ট্রোলের বোতামে চাপ দিলেন রাহাত খান। লাল আলো জ্বলতে বোঝা গেল ভিসিআর সচল হয়েছে, তারমানে রেকর্ড করা একটা ক্যাসেট আগেই ঢোকানো হয়েছে ওটায়। পরমুহূর্তে টিভির স্ত্রীন উত্তাসিত হয়ে উঠল।
ছবিটা তোলা হয়েছে আসমানের অনেক- ওপর থেকে, স্যাটেলাইটে বসানো ক্যামেরার সাহায্যে ।
“এলাকাটা চিনতে পারছ?’ জিজ্ঞেস করলেন রাহাত খান।
‘জ্বী, স্যার। প্রশান্ত মহাসাগরের ছবি ।’
এরপর জুম লেন্সের সাহায্যে স্যাটেলাইট ক্যামেরা প্রশান্ত মহাসাগরের একটা দ্বীপ পুঞ্জের ওপর ফোকাস করল, প্রতিমুহূর্তে দ্বীপগুলোর আকৃতি, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। খুঁটিনাটি আলাদাভাবে চেনা গেল। পালা করে এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে ফোকাস হচ্ছে ক্যামেরা । ছবিতে এখন লোকজনও দেখা যাচ্ছে । ব্যাপারটা ধরতে রানার বেশি সময় লাগল না। “স্যার, সবগুলো দ্বীপ থেকেই তো দেখছি মানুষজনকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে!
হ্যা, ঠিক ধরেছ, রাহাত খান বললেন । “খেয়াল করে দেখো, মাঝখানের দ্বীপটাই সবচেয়ে বড়। ওখানকার লোকজনকে একমাস আগেই সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখন কাজ চলছে আশপাশের অন্তত বারোটা দ্বীপ খালি করার ।’
‘কেন, স্যার?
উত্তরটা তুমিই দাও, বললেন রাহাত খান। “তোমার……………