একটু চোখ বুলিয়ে নিন
মিশরীয় নৌ-বাহিনীর সাবমেরিন থেকে ইসরায়েলি উপকূল রেখা এখন আর বেশি দূরে নয়। সাবমেরিনের কন্ট্রোল রূমে শুধু লাল আলোর আভা ছড়িয়ে রয়েছে। নেভিগেশন অফিসার , আমির আব্বাস, সামনের দিকে ঝুঁকে ক্যাপটেনের হাত ছুঁল। ‘পৌছে গেছি, স্যার।
লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার নাজিম মোসাদ্দেক মাথা ঝাকালেন। স্টপ অল। প্লেইন মিডশিপস ।’
ওয়াচকীপার সাড়া দিল, ‘অল স্টপড।’
প্লেইন মিডশিপস, দু’জন প্লেইনম্যানের মধ্যে সিনিয়র লোকটা জবাব দিল। তার সামনে ছোট্ট একটা প্যানেল রয়েছে, ওটার সাহায্যে হাইড্রোপ্লেইন অপারেট করা হয়। হাইড্রোপ্রেইনের কাজ হল সাবমেরিনের গভীরতা নিয়ন্ত্রণ।
‘সোনার?’ শাস্তস্বরে জানতে চাইলেন ক্যাপটেন।
“হাইফা বন্দরে স্বাভাবিক তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দুটো ছোট পেট্রল বোট, তবে পঞ্চাশ মাইল দূরে ! বেয়ারিং জিরো-ট্-জিরো । চারপাশে কোন সাবমেরিন নেই ।
লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার নাজিম মোসাদ্দেক ভুরু কোচকালেন। তার মনে শান্তি নেই। একটা কারণ , মিশরীয় নৌবাহিনীর এই অমূল্য সম্পদটিকে নিষিদ্ধ ও বিপজ্জনক জলসীমায় নিয়ে আসার কোন ইচ্ছে তার ছিল না। আরেকটা কারণ, টিকটিকিদের পছন্দ করেন না তিনি ।
তিনি জানেন, টিকটিকি বলা হয় গোয়েন্দাদের । তবে তাঁর কাছে গোয়েন্দা বা স্পাই, দুটোই সমান। যা-ই বলা হোক; ওদেরকে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া়য় খুশি হতে পারেননি তিনি, যদিও তাকে জানানো হয়েছে ওদের লিডার নাকি কাল্পনিক চরিত্র জেমস বণ্ডের তুলনায় কোন দিক থেকে কম নয়। তাকে আরও জানানো হয়েছে, স্পাইদের এই দলটাকে মিশরের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধরষ্ট্র থেকে পাঠানো হয়েছে। যুদ্ধের সময়ে নাজিম মোসাদেক ইসরায়েলি উপকূলে গোপনে হামলা চালিয়েছেন, প্রয়োজনে অসম্ভব সব ঝুঁকিও নিয়েছেন, কিন শান্তির সময়ে এ-ধরনের ঝুঁকি নেয়ার ঘোর বিরোধী তিনি।
টিকটিকিরা যখন সাবমেরিনে এল, তিনি ভেবেছিলেন লিডার লোকটাকে মেজর বলা হলেও ওটা হয়ত তার কাভার। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সবিম্ময়ে উপলব্ধি করলেন তিনি, বিদেশী মেজর সাগর ও সাবমেরিন সম্পর্কে যা কিছু জানার প্রায় সবই জানে । তার দুই সঙ্গী সম্পর্কেও কথাটা সত্যি। অবাক কাণ্ড, সাগর সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ অথচ তাকে মেজর বলা হচ্ছে! এতে করে তার মানসির শান্তি কমল বৈ বাড়ল না। লিডারের নাম মেজর কাজটার নামও অপারেশন মেজর।
নৌ-বাহিনীর সদর দফতর থেকে পরিষ্কার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে, প্রতিটি শব্দ এখনও স্মরণ করতে পারেন তিনি।
‘মেজর এবং তার দলকে সব রকম সাহায্য করবেন আপনি পানির নিচ দিয়ে, নিঃশব্দে, সম্ভাব্য দ্রুতগতিতে রদেভোয় পোছুবেন।
নির্দেশের সাথে একটা চার্টও দেয়া হয়েছে। সেটা দেখে রীতিমত আঁতকে ওঠেন লে. ক. নাজিম মোসাদ্দেক । বৈরুত আর তেল আবিবের মাঝখানে, হাইফা উপকূলের পাচ মাইলের মধ্যে পৌছুতে হবে তাকে। ‘রদেভোয় পৌছে পানির নিচে অপেক্ষা করবেন আপনি । সরাসরি মেজরের নির্দেশ মেনে চলতে ‘হবে’ আপনাকে । কোন অবস্থাতেই অন্য কোন জলযানকে নিজেদের উপস্থিতি জানতে দেবেন না, বিশেষ করে হাইফা বন্দরে টহলরত ইসরায়েলি ন্যাভাল ইউনিটগুলোকে। রদেভোয় পৌছুবার পর, সম্ভাবনা আছে সঙ্গীদের নিয়ে বোট ছেড়ে নামতে চাইবেন মেজর। ওঁদের সাথে
ইনফ্লেটেবল আছে। ওরা নেমে যাবার পর পেরিক্কোপ গভীরতায় ডুবে থাকবেন আপনারা, ওদের, ফেরার অপেক্ষায় । তিন ঘন্টা পরও ওরা যদি না ফেরেন, আপনার আর অপেক্ষা করার দরকার নেই। পানির তলা দিয়ে নিঃশব্দে চলে আসুন; রিপোর্ট করুন বেসে । আর যদি মেজরের মিশন সফল হয়, তিনি সম্ভবত আরও দু’জন মানুষকে নিয়ে ফিরে আসবেন। তাদের জন্যে সব রকম আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করবেন আপনি । তারা বোটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বেসে ফেরার জন্যে রওনা হবেন।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এই অপারেশন পরিচালিত হবে অফিশিয়াল সিক্রেট আ্যাক্ট অনুসারে । আপনার ক্রুদের সবাইকে জানিয়ে দেবেন, এই অপারেশন সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে বা অন্য কারও সঙ্গে আলাপ করা যাবে না। আপনি বেসে ফিরলে, ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে, একটা আ্যাডমিরাল্টি টিম ডিব্রিফ করবে ।’
‘জাহান্নামে যাক মেজর!” মনে মনে অভিশাপ দিলেন নাজিম মোসাদ্দেক । পানির তলায় লুকিয়ে থাকলেও, নিজেদের নিরাপদ জলসীমায় ঘোরাফেরা করাও একটা সাবমেরিনের জন্যে বিপজ্জনক । আধুনিক সোনার ও টর্পেডো এতই উন্নত যে কখন আঘাত লাগবে বলা কঠিন। হোক শান্তির সময়, পরম শক্রর জলসীমায় ঢুকে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করা আত্মহত্যার সামিল ৷ কিন্তু কে কার কথা শোনে! তাকে এমনকি প্রতিবাদ করারও সুযোগ দেয়া হয়নি।
“পেরিস্কেপ ডেপথ,’ বিড়বিড় করে অর্ডার দিলেন নাজিম মোসাদ্দেক, লক্ষ করলেন্ নিঃশব্দে পরিচালিত বোটের ভেতর থমথম করছে পরিবেশ। জানা কথা, তার ক্রুরাও ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিতে পারেনি ।
ধীরে ধীরে সাবমেরিনকে ওপর দিকে তুলল প্লেইনম্যানরা। সারফেস থেকে দুশো পঞ্চাশ ফুট নিচে এখন তারা । থামল সাবমেরিন । ‘পেরিক্কোপ ডেপথ, স্যার ।’
‘আপ পেরিক্কোপ।”
নিরেট ধাতব টিউব ওপর দিকে উঠে গেল, টান দিয়ে হ্যাণ্ডেলটা নিচে নামালেন নাজিম মোসাদ্দেক । নাইট ভিশন-এর সুইচ অন করে চারদিকটা একবার দেখে নিলেন তিনি। দূরে শুধু উপকূল রেখা দেখা গেল, সমতল ও ফাঁকা, দেখার মতো কিছুই নেই- না কোন জাহাজ, না কোন আলো। এমনকি একটা মাছ ধরার বোট ও চোখে পড়ল না।
‘ডাউন পেরিস্কোপ’।
হাতলটা ঠেলে উপরে তুলে দিলেন তিনি, দু’পা এগিয়ে রেডিও ব্যাঙ্ক- এর সামনে চলে এলেন, হাত বাড়িয়ে তুলে নিলেন ইন্টারনাল ব্রডকাস্ট মাইক্রোফোনটা। বোতাম টিপে নিচু গলায় বললেন, “মেজর টু কন্ট্রোল রূম, প্লীজ।’
মেজর আর তার দলকে ওপরতলায় যেখানে ঠাই দেয়া হয়েছে সেটার নাম ফোর-এগুস। খালি জায়গা একমাত্র এটাই পাওয়া গেছে। ওদের চারদিকে লাল চিহ্ন দেয়া সেফটি ইকুপমেন্ট, পিছনে এক সেট টর্পেডো টিউব। ওদের জন্যে বিশেষভাবে তৈরি তিনটে বাঙ্ক-এর ওপর শুয়ে আছে তিনজন, ডেক থেকে চার ফুট ওপরে । শুয়ে থাকলেও, অভিযানের জন্যে আগেই তৈরি হয়ে নিয়েছে ওরা? প্রত্যেকে কালো রাবারের ডাইভিং সুট পরেছে, সাথে ওয়াটারপ্রুফ হোলস্টার, বেল্টের সঙ্গে আটকানো। ভাজ খুলে ইনফ্লেটেবলটাও নাগালের মধ্যে রাখা হয়েছে।
ক্যাপটেন ডাকছেন শুনে ধাতব ডেকের ওপর দাঁড়াল মেজর, শান্তভাবে এগোল কন্ট্রোল রুমের দিকে । আন্তর্জাতিক এসপিওনাজ জগতে দীর্ঘদিন বিচরণ করছে, ‘ইনার সার্কেল’-এ পড়ে, এমন লোকের সংখ্যা খুব বেশি নয়, একমাত্র তারাই মেজরকে বিসিআই এজেন্ট মাসুদ রানা বলে চিনতে পারবে। ওর সঙ্গীরা বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর ন্যাভাল স্পেশাল বোট স্কোয়াড্রন-এর সদস্য । বিসিআই, বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স, নৌ-বাহিনী থেকে ওদের দু’জনকে ধার করেছে । এর আগেও মেজর মাসুদ রানার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে ওদের।
রানা কন্ট্রোল রূমে ঢুকতে মুখ তুলে তাকালেন নাজিম মোসাদ্দেক। ‘আমরা আপনাদের ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌছে দিয়েছি ।’ তার হাবভাবে আনন্দ বা বিদ্বেষ কোনটাই নেই, স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা পালন করছেন।
মাথা ঝাকাল রানা । ‘গুড । আসলে এক ঘন্টা আগে পৌচেছি আমরা। ভালই হল, অনুকূল বাতাস পাওয়া যাবে ।’ বা কব্জিতে বাধা স্টেনলেস স্টীল রোলেক্সের ওপর চোখ বুলাল একবার । ‘বিশ মিনিটের মধ্যে রওনা হতে চাই
আমরা । সম্ভব?
“অবশ্যই । কতক্ষণ সময় নেবেন আপনারা?’
“ধরে নিচ্ছি বোটটাকে আপনি আংশিক পানির ওপর তুলবেন। ইনফ্লেটেবলে বাতাস ভরব আমরা, বৈঠা চালিয়ে বোটের গা থেকে খানিকটা দূরে সরে যাব- কতক্ষণ লাগবে, দশ কি পনেরো মিনিট ।’
“আর শুধু নির্দেশ মত রেডিও সিগন্যাল ব্যবহার করব?’
বিপদ দেখা দিলে আপনার তরফ থেকে তিনবার ব্রাভো সঙ্কেত। আমাদের তরফ থেকে দু’বার ডেলটা সঙ্কেত, আমরা যখন চাইব, আবার পানির ওপর উঠে আমাদেরকে আপনারা গ্রহণ করুন। যেমন আয়োজন করা হয়েছে, সেইল-এর ফরওয়ার্ড এগজিট হ্যাচ ব্যবহার করব আমরা-ওখানে কোন সমস্যা নেই, আশা করি?
কেসিং- এর ওপরটা পিচ্ছিল থাকবে, বিশেষ করে আপনাদের ফেরার সময় । সাহায্য করার জন্যে দু’জন রেটিংকে পাঠাব আমি ।’
‘এক প্রস্থ রশিও। ভাল্ হয় মই হলে। আমার যতটুকু জানা আছে, অতিথি হয়ে যারা আসছেন তাদের সাবমেরিনে চড়ার কোনও পূর্ব-অভিজ্ঞতা ত নেই, রাতের অন্ধকারে তো নয়ই।”
“আপনারা তাহলে তৈরি হয়ে নিন ।’ শুধু অতিথি নয়, অতিথিদের অতিথি আছে, তাদেরকেও চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তার ঘাড়ে; ভাবতে গিয়ে মন আরও খানিকটা বেজার হল ক্যাপটেন নাজিম মোসাদ্দেকের।
“রাইট, শিপশেপ হতে যতক্ষণ লাগে ।’ স্পেশাল বোট স্কোয়াড্রন অফিসারদের কাছে ফিরে এল রানা । প্রথমজন ক্যাপটেন কাজল রহমান, বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী। দ্বিতীয়জন নুরুল হক, বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী। শেষ মুহুর্তে নিজেদের মধ্যে একটা মহড়া দিয়ে নিল ওরা। যদি কোন জটিলতা বা বিপদ দেখা দেয় তাহলে কে কি করবে, কার কি ভূমিকা হবে। মহড়া শেষ হতে ইনফ্লেটেবল, বৈঠা ও ছোট্ট লাইট ওয়েট এঞ্জিনটা ধাতব মইয়ের কাছে বয়ে নিয়ে এল ওরা। এই মই উঠে গেছে ফরওয়ার্ড হ্যাচে, সেখান থেকে কেসিং-এ। কেসিং-এর.পর আর কিছু নেই, আছে শুধু ভূমধ্যসাগরের ঢেউ আর ঠাণ্ডা পানি। মইয়ের গোড়ায় অয়েলস্কিন পরা দু’জন রেটিং অপেক্ষা করছিল ওদের জন্যে, নির্দেশ পেলেই মই বেয়ে উঠে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে আছে একজন।
কন্ট্রোল রূমে কেউ কোন কথা বলছে না। আরেকবার পেরিস্কোপে চোখ রেখে চারদিকটা ভাল করে দেখে নিলেন নাজিম মোসাদ্দেক। তারপর সাবমেরিনকে কেসিং পর্যন্ত পানির ওপরে তোলার নির্দেশ দিলেন। সেই সঙ্গে আরেকটা নির্দেশ দিলেন তিনি, “ব্ল্যাক লাইট ।’
তার দ্বিতীয় নির্দেশ পালিত হওয়ার সাথে সাথে সাবমেরিনের ভিতরটা পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেল। সামান্য আলোর আভা দেখা গেল শুধু কন্ট্রোল রূমে, ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেল থেকে ছড়াচ্ছে । অবশ্য মাঝে মধ্যে শেড পরানো লাল টর্চ জ্বালা হল। এই রকম একটা টর্চ রয়েছে মইয়ের গোড়ায় দাড়ানো রেটিংদের একজনের হাতে । স্পীকার থেকে ভেসে এল, ‘কেসিং সারফেসড!” সঙ্গে সঙ্গে মই বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল সে।
হুইল ঘুরিয়ে ফরোয়ার্ড হ্যাচের তালা খুলল রেটিং। মাথার ওপর সদ্য তৈরি অর্ধবৃত্ত থেকে তাজা ও ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকল ভেতরে। এরপর মই বেয়ে ওপরে উঠল নুরুল হক, রেটিঙের টর্চ ম্লান লাল আলো ফেলল মইয়ের ধাপে। মই বেয়ে উঠতে শুরু করেছে কাজল রহমানও, মাঝপথে থামল সে, রানার কাছ থেকে ইনফ্লেটেবল্টা নিয়ে একটা প্রান্ত ধরিয়ে দিল নুরুল হকের হাতে, দু’জন ধরাধরি করে ভারি জিনিসটা তুলে ফেলল কেসিং-এর ওপর। ওদের পিছু নিল রানা, দ্বিতীয় রেটিং ওর হাতে তুলে দিল বৈঠা ও লাইটওয়েট এঞ্জিন। এঞ্জিনটা বাংলাদেশ ‘নৌ-বাহিনীর সম্পদ । ব্যবহার করা অত্যন্ত সহজ। প্রপেলার ব্লেডগুলো আকারে ছোট, দ্রুত ও প্রায় নিঃশব্দে ছুটতে পারে। ফুয়েল ট্যাংকটা ইনফ্লেটেবলের পিছনে |
সবশেষে নুরুল হকের হাতে এয়ার টিউবটা ধরিয়ে দিল রানা। পিচ্ছিল মেটাল কেসিং এ উঠে এসে দেখল ইনফ্লেটেবল নিজের আকৃতি ফিরে পেয়েছে-সরু ও লম্বা, সিটগুলো বালতি আকৃতির, ধরার জন্যে প্রতিটি সিটের সঙ্গে হাতলও আছে।
ওয়েট সুটে আটকানো দু’মুখি রেডিওটা চেক করল রানা। তাল সামলে দাড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে ও, ওর সঙ্গীরা ইনফ্লেটেবলটাকে পানিতে ভাসাল। নিচু, গোলাকার বো-তে ‘দাড়িয়ে রয়েছে একজন রেটিং, টেনে ধরে থাকল একটা রশি, যতক্ষণ না বৈঠা ও এঞ্জিন ইনফ্লেটেবলে নামানো হল। এরপর কেসিং থেকে হড়কে নেমে গেল রানা, নিজের জায়গা স্টার্নে বসল। রশিটা ছেড়ে দিল রেটিং, ঝাঁকি খেয়ে সাবমেরিনের গা থেকে দূরে সরে এল ওদের যান্ত্রিক ভেলা ।
ছোট্ট জলযানটাকে স্রোতের টানে সাবমেরিনের কাছ থেকে সরে আসতে দিল ওরা, গলার সঙ্গে বাধা আলোকিত কম্পাস চোখের সামনে তুলে দ্রুত একটা রিডিং নিল রানা । রিডিংটা নৌ-অফিসারদের পড়ে শোনাল ও, তারপর ওর সামনের প্লাস্টিকের গর্তে কম্পাসটা রেখে নিজের বৈঠা তুলে নিয়ে সেটাকে হাল ব্যবহার করল, রওনা হবার নির্দেশ দিল সঙ্গীদের । সাগরের পানি কালো, চকচক করছে।
দ্রুত বৈঠা চালিয়ে এগোল ওরা। দু’মিনিট পর কোর্স চেক করল রানা, আর ঠিক তখনই পানির ফোঁস ফোঁস আওয়াজ শুনতে পেল, বুঝল সাবমেরিনটা ডুব দিল পানির নিচে। ওদের চারদিকে রাতের অন্ধকার ও সাগর মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে, কোনটাকেই আলাদা ভাবে চেনার উপায় নেই।’ এক নাগাড়ে আধ ঘন্টা বৈঠা চালাল ওরা, দু’একমিনিট পরপর কম্পাসে চোখ রেখে দিক সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিল রানা । এতক্ষণে ইসরায়েলি উপকূল রেখা দেখতে পেল ওরা । তীরে পৌছুতে এখনও অনেক দেরি আছে। যত জোরেই বৈঠা চালানো হোক, তিনজন লোককে নিয়ে ভেলাটার গতি মোটেও বেশি নয়। সব যদি ঠিক ঠাক ম ঘটে, দ্রুত সাবমেরিনে ফেরার জন্য লাইটওয়েট এঞ্জিনটা ব্যবহার করতে পারবে ওরা। এখন আর কেউ বৈঠা চালাচ্ছে না। স্রোতের টানে নিজেই ভেসে চলেছে যান্ত্রিক ভেলা। সবাই প্রস্তুত এবং সতর্ক। কারণ বিপদ হওয়ার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা এখনই। ভেলার পিছন দিকে দাঁড়িয়ে পড়ল কাজল রহমান, শেডহীন টর্চটা সৈকতের দিকে তাক করে দু’বার আলো জ্বালল সে । সৈকত থেকে সাথে সাথে সাড়া পাওয়া গেল। দু’বার আলো জ্বেলে মোর্স কোডের জবাব
দেয়া হল।
‘ওরা এসেছে, বিড়বিড় করল রানা।
“ওরা একা হলেই হয়, ফিসফিস করল নুরুল হক।
ভেলাটা সৈকতে পৌছুবার আগেই লাফ দিয়ে পানিতে নামল কাজল
রহমান, বো-র রশি ধরে ভেলাটাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠল । বালির ওপর দিয়ে ছুটে আসতে দেখা গেল কালো দুটো মুর্তিকে।
‘মাই পীস ইস গন’ আবৃতি করল রানা। রাত দুপুরে নির্জন ইসরায়েলি সৈকতে মহাকবি গ্যেটের কবিতা আবৃত্তি করা, উদ্ভট ও হাস্যকর লাগল ওর।
পানির কিনারায় দাঁড়ানো মুর্তি দুটোর একটা জবাব দিল, মাই হার্ট ইস হেভি’।’
দ্রুত ভেলায় তোলা হল ওদেরকে, তিনজনই বাড়িয়ে দিল সাহায্যের হাত। আগন্তুকদের জা়য়গা করে দেয়া হল ভেলার মাঝখানে । সামনের রশিতে টান দিয়ে ভেলাটাকে ঘোরাল কাজল রহমান। কম্পাস দেখে নিয়ে ফেরার কোর্স নির্ধারণ করল রানা । কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে বৈঠা চালিয়ে সৈকত থেকে দূরে সরে এল ওরা। ত্রিশ মিনিট পর এঞ্জিন চালু করবে, সেই সঙ্গে প্রথম বার সঙ্কেত পাঠাবে অপেক্ষারত সাবমেরিনকে ।’
ওদের ভেলায় একটা শর্ট-ডিসট্যান্স সিগন্যালিং ডিভাইস রয়েছে, কাজেই সাবমেরিনের সোনার অপারেটর ওদের ফিরতি অভিযানটা মনিটরিং করতে পারল । শুধু ভেলা নয়, ভেলার চারদিকেও কড়া নজর রাখছে সে । একই কাজ
করছে তার সহকারীও, তবে তার নজর রাখার ক্ষেত্রটি আরও অনেক বড়।
“মনে হচ্ছে, স্যার, ওরা বোধহয় ফিরে আসছেন, সিনিয়র সোনার অপারেটর জানাল ।
‘এঞ্জিন চালু করলে আমাকে জানাবে ।’ ক্যাপটেন নাজিম মোসাদ্দেক উত্তেজনায় আড়ষ্ট হয়ে আছেন। গোটা ব্যাপারটা কি নিয়ে, তার জানা নেই; জানতে তিনি চানও না। তিনি শুধু আশা করতে পারেন তার আরোহীরা নিরাপদে ফিরে আসবেন, এবং যাদেরই- তারা সাথে করে নিয়ে আসুন, সবাইকে বহাল তবিয়তে পৌছে দেবেন ঘাটিতে।
ইয়েস, স্যার। আমার ধারণা… হায় আল্লাহ…! হেডফোনে সঙ্কেত শুনে আতকে উঠল সোনার অপারেটর, স্ক্রীনে ফুটে ওঠা বিপগুলোর দিকে চোখ বড় করে থাকাল। ওঁদেরকে ধাওয়া করা হচ্ছে স্যার! রুদ্ধশ্বাসে বলল সে। ‘বেয়ারিং জিরো-সেভেন-ফোর। ছোট্ট একটা বোট, স্যার। ওদের স্টারবোর্ড সাইডে, হেড়ল্যাণ্ডের পিছন থেকে আস্ছে। অত্যন্ত হালকা বোট, স্যার। হালকা, দ্রুতগামী । আমার ধারণা ওটা একটা চেলা, স্যার ।’
দাঁতে দাঁত ঘষলেন নাজিম মোসাদ্দেক, ক্রুদের সামনে সচরাচর যা করেন না তিনি। চেলা হল রাশিয়ার তৈরি পেট্রল হাইড্রোফয়েল। এ জিনিস ইসরায়েলিদের হাতে থাকার কথা নয়, সম্ভবত তৃতীয় কোন দেশের মাধ্যমে জোগাড় করা হয়েছে । নতুন নয়, ইতিমধ্যে পুরানো হয়ে গেছে চেলা । ওটায় দু’জোড়া ১৩ এম এম মেশিনগান আছে, আর আছে পট ড্রাম সার্চ রাডার। গতি অত্যন্ত দ্রুত, অগভীর পানি হোক বা উত্তাল সাগর, সবখানে তীরবেগে
চলাচল করতে পারে।
‘চেলাই, স্যার, কোন সন্দেহ নেই-সরাসরি ওদের দিকে ছুটছে,
মাঝখানের দূরত্ব কমে আসছে দ্রুত, এক নিঃশ্বাসে বলল সোনার অপারেটর ।
ভেলায় ওরা পেট্রল বোট এঞ্জিনের ভারি শব্দ শুনতে পেল, সৈকত থেকে
রওনা হবার একটু পরই।
‘আমরা কি এঞ্জিন ব্যবহার করব? চেষ্টা করব পালাতে?” চাপা কণ্ঠে রানাকে জিজ্ঞেস করল কাজল রহমান।
“পালানো সম্ভব নয়।”‘ কি করতে হবে জানে রানা, কিন্তু কাজটার পরিণতি সম্পর্কে মাথা ঘামাতে মন চাইছে না।
সিদ্ধান্ত নেয়ার কঠিন দায়িত্ব থেকে ওকে রেহাই দিল কাজল রহমান, পিছন দিকে ঝুঁকে রানার উদ্দেশে বলল সে, ওটাকে কাছে আসতে দাও, বিস্ফোরণের জন্যে তৈরি থাকো । আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো না। লিমপেট আমাকে ঘায়েল না করলে সৈকত ধরে কেটে পড়ার চেষ্টা করব আমি । উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনীদের শিবির সৈকত থেকে খুব বেশি দূরে নয় ।’ কথা শেষ করেই ভেলা থেকে ঝুপ করে পানিতে পড়ল সে, চোখের নিমেষে সাগর গ্রাস করল তাকে ।
রানা জানে, কাজল রহ্ছেমানের কাছে একজোড়া ছোট লিমপেট মাইন আছে। ঠিকমত বসাতে পারলে হাইড্রোফয়েলের ফুয়েল ট্যাংকে দুটো ফুটো তৈরি হবে । আরও জানে, মাইন বিস্ফোরণে সম্ভবত কাজল রহমান নিজে ও মারা যাবে।
ঠিক সেই মুহূর্তে ওদের ওপর সার্চলাইটের চোখ ধাধানো আলো পড়ল। পেট্রল বোটের গতি কমে গেল | থামছে ওটা। ভেলা ও পেট্রল বোটের মাঝখানে এখন দূরত্ব খুব বেশি নয়। লাউডহেইলার থেকে হিব্রু ভাষায় নির্দেশ ভেসে এল, ‘হল্ট! হল্ট! দিস ইজ আ মিলিটারি অর্ডার! পরিচয় আর উদ্দেশ্য জানার জন্যে তোমাদেরকে আমরা বোটে তুলব। তোমরা না থামলে গুলি করতে বাধ্য হব আমরা । হল্ট! হল্ট!
মাথার ওপর হাত তোল,’ নূরুল হককে বলল রানা । “ওদেরকে দেখাও তুমি নিরস্ত্র। যা বলে শোন। একটা বিস্ফোরণ ঘটবে । আওয়াজ পেলেই দুই হাটুর মাঝখানে মাথাটা গুজে দেবে ।’
‘তারপর চোখ খুলে দেখব বেহেশতে বসে শরাবান তহুরার গ্রাসে চুমুক দিচ্ছি…’ বিড় বিড় করল নুরুল হক।
‘…খুলিটা ঢেকে রাখবে দু’হাতে |”
মৃদু ভটভট শব্দ করছে পেট্রল বোটের এঞ্জিন, স্রোতের টানে ভেসে আসছে ওদের দিকে । সার্চলাইট স্থির হয়ে আছে। দূরত্ব যখন পঞ্চাশ গজের মত, চোখ ধাধানো সাদা শিখায় ঢাকা’ পড়ে গেল সেটার বো। প্রতি মুহূর্তে রঙ বদলাল সাদা শিখা, গোলাপি হয়ে উঠল। প্রথমে আলো দেখল ওরা, এক সেকেন্ড পর বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পেল । দ্বিতীয় বিস্ফোরণটা ঘটল আরও এক সেকেগু পর। মাথা তুলে তাকাল রানা, দেখল মাইনগুলো ঠিক জায়গাতেই বসিয়েছে
কাজল রহমান। ভাবল, এ-ধরনের কাজে ভুল তার না হওয়ারই কথা৷ বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর স্পেশাল বোট স্কোয়াড্রনের অফিসার সে, বিশেষ করে পেট্রল বোটের ঠিক কোথায় মাইন বসালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে জানা আছে তার। বোটের্ পুরোটা দৈর্ঘ্য জুড়ে আগুন জ্বলছে, ফয়েল সহ বো- টা পানি ছেড়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। ডুবে যেতে কয়েক মিনিটও লাগবে না।
বিস্ফোরণের ধাক্কায়, একদিকে ছিটকে পড়েছে ওদের যান্ত্রিক ভেলা, নিয়ত্রণ না থাকায় পানির ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে লাইট ওয়েট এঞ্জিনটা তুলল রানা । ভেলার পিছন দিকের পানিতে ডোবাল সেটাকে, জায়গামত বসিয়ে চাপ দিল ইগনিশন বোতামে।
চালু হল এঞ্জিন। প্রপেলার ব্রেডগুলো সবেগে ঘুরছে । হাতলটা শক্ত করে ধরল রানা । এটার সাহায্যে ভেলার গতি ও দিক, দুটোই নিয়ন্ত্রণ করতে
পারবে ও।
নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হুয়ে উঠল রানা । বিধ্বস্ত পেট্রল বোটের আগুন গোটা এলাকা অনেক দূর পর্যন্ত আলোকিত করে রেখেছে। অনেকগুলো প্রশ্ন ভিড় করে এল ওর মনে । উপকূল জুড়ে কড়া প্রহরা দিচ্ছে ইসরায়েলি নৌ-বাহিনী , পেট্রল বোটটা কি আগেই ওদের উপস্থিতি সম্পর্কে অন্যান্য বোটকে সতর্ক করেছিল? ভূমির কোন ঘাটি বা দ্রুতগামী কোন জলযানের রাডারে ওদের ভেলা কি ধরা পড়ে গেছে? লিমপেটগুলো বসাবার পর কাজল রহমান কি নিরাপদ দুরত্বে সরে আসতে পেরেছে? মনে হুয় না।
বিস্ফোরণের পর মিশরীয় সাবমেরিন কি করবে, আক্রান্ত হবার ভয়ে চুপিসারে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করবে না তো? পালিয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি, কারণ নাজিম মোসাদ্দেকের বিবেচনায় সাবমেরিনটা তাদের একটা অমূল্য সম্পদ, তার তুলনায় অপারেশন মেজর কিছুই না।
কাজল রহমান। যদিও অপেক্ষা করতে নিষেধ করেছে সে, তবু কিছক্ষণ অন্তত দেখবে রানা । দেশের, স্বার্থে যে-লোক বিনা দ্বিধায় প্রাণ বিসর্জন দিতে …………………
সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।