Masud Rana - Dui Number

দুই নম্বর – মাসুদ রানা – কাজী আনোয়ার হোসেন (Dui Number – Masud Rana By Kazi Anwar Hossain)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

লিবীয়ার মিলিটারি ট্রেড মিশন কমপ্লেক্স ত্রিপোলি থেকে পনেরো কিলোমিটার দক্ষিণ-পুর্বে। উপকূলের কাছাকাছি, কমপ্লেক্সটা কৌতূহলী থেকে সযত্নে আড়াল করা- চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে মিষ্টি-গন্ধী ইউক্যালিপটাস, পরিণত সাইপ্রেস আর আকাশছোয়া পাইন। আকাশ থেকে দেখলে একটা কারাগার বলে ভুল হতে পারে । কিডনি আকৃতির জায়গাটাকে বেড় দিয়ে রেখেছে তিনটে আলাদা, ছয় মিটার উঁচু সাইক্রোন ফেন্স, প্রতিটির মাখায় আরও এক মিটার উচু ইলেকট্রিফায়েড কাটাতার । রাতে বেড়া গুলোর ফাঁকে টহল দেয় একদল কুকুর, পেরিমিটারের বাইরে নিয়মিত চক্কর দেয় আর্মারড কার । কমপাউণ্ডের ভেতর বিন্ডিংগলো সবই প্রয়োজনের কথা মনে রেখে তৈরি করা হয়েছে । নিচু কাঠের ব্যারাকে থাকে সিকিউরিটি ফোর্সের লোকজন। আরও দুটো কাঠামো ‘হোটেল’ হিসেবে পরিচিত-একটা বিদেশী সামরিক প্রতিনিধিদের জন্যে, অপরটা তাদের প্রতিপক্ষ লিবীয়দের জন্যে।


হোটেল দুটোর মাঝখানে গভীরদর্শন একটা একতলা বিল্ডিং রঙটা হালকা লাল। ওটার দেয়ালগুলো এক মিটার চওড়া, সামনে এক সারি খিলান, কয়েকটাধাপ পেরিয়ে সদর দরজায় পৌছুতে হয়। একটা মাত্র করিডর ভেতরটাকে দু’ভাগ করেছে। প্যাসেজের ডান ও বাম দিকে প্রশাসনিক দপ্তর আর রেডিও রুম। শেষ মাথায় একজোড়া ভারি ও উঁচু দরজা, ভেতরে লঙ্কা, সরু একটা কামরা। বিরাট কনফারেন্স টেবিল ও চেয়ার ফেলা আছে, আছে ছায়াছবি প্রদর্শনের সরঞ্জাম, ভিটিআর ও স্লাইড ।
গোটা কমপ্লেক্সে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কামরা এটা । কোন জানালা নেই, তাপমাত্রা ঠিক রাখা হয় এয়ারকন্ডিশনিং এর সাহায্যে। শেষ প্রান্তে ছোট একটা ধাতব দরজা আছে, ব্যবহার করে ক্লিনার আর সিকিউরিটির সদস্যরা।

মিলিটারি ট্রেড মিশন কমপ্লেক্স বছরে পাঁচ কি ছয়বার ব্যবহার করা হয়। এখানকার সমস্ত তৎপরতা পশ্চিমা ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলো মনিটর করে, যতটুকু সম্ভব।


ঘটনার দিন সকালে কম্পাউণ্ডের ভেতর কাজ করছিল সম্ভবত একশো চল্লিশ
জন মানুষ।

পশ্চিমা জগতের অনেক ইন্টেলিজেন্স এজেপ্সির কাছেই খবর ছিল, একটা চুক্তি সম্পাদিত হতে যাচ্ছে। সরকারী বিবৃতি কেউ আশা করেনি, তবে আন্দাজ করা যায় যে লিবীয়া আরও কিছু মিসাইল, ফাইটার প্লেন, বাছাই করা মিলিটারি হার্ডওয়্যার ইত্যাদি পেতে যাচ্ছে।

শেষ ও চূড়ান্ত আলোচনা শুরু হবার কথা সোয়া ন’টায়। দুই পক্ষই প্রটোকল মেনে চলার ব্যাপারে কঠোর । লিবিয়ানরা সংখ্যায় প্রায় বিশজন, রাশিয়ানরাও তাই। লালচে রঙের বিল্ডিঙয়ের সামনে মিলিত হলো তারা কুশলাদি বিনিময়ের পর ভেতরে ঢুকল সবাই। করিডোর ধরে হেটে কনফারেন্স রুমের দিকে এগোল। দু’জন সশস্ত্র প্রহরী নিঃশব্দে খুলে দিল দরজা ।

দুই দলের প্রায় অর্ধেক মানুষ কামরার ভেতর ঢুকেছে, এই সময় গোটা মিছিলটা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, চোখের সামনে দৃশ্যটা যেন নিরেট পাথরে পরিনত করল তাদের ।

কামরার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে দশজন লোক, সবার পরনে একই পোশাক। তারা এমনভাবো দাড়িয়েছে, ঠিক যেন কাস্তে আকৃতির চাঁদ। সবার পরনে কমব্যাট জ্যাকেট আর লেদার বুটে ঢোকানো ডেনিম ট্রাউজার। তাদের চেহারা আরো ভীতিকর করে তুলেছে মুখ ঢেকে রাখা কেমোফ্লেজ নেট, কালো বেরেট-এর সাহায্যে নেটগুলো জায়গা মত স্থির রাখা হয়েছে। প্রতিটি বেরেটে পালিশ করা ব্যাজ আটকানো । ব্যাজে রয়েছে মানুষের একটা খুলি, খুলির ওপর
লেখা–এন. এস. এ. এ. |

ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য, কারণ দুই পক্ষের প্রতিনিধিরা বিল্ডিঙের সামনে আসার
পনেরো মিনিট আগে লিবিয়ান অফিসাররা কামরাটা পরীক্ষা করে গেছে।

দশটা মূর্তি একযোগে ক্লাসিক ফায়ারিং পজিশন নিল- বাম পা সামনে, হাটুর কাছে ভাজ হয়ে আছে, মেশিন পিস্তল বা অটোমেটিক রাইফেলের বাট সেটে আছে নিতন্বে। দশটা মাজল তাক করা হলো এরইমধ্যে কামরার ভেতর ঢুকে পড়া
প্রতিনিধি ও বাইরের করিডরে দীড়িয়ে থাকা লোকজনদের দিকে । অন্তত দু’সেকেন্ড গোটা দৃশ্যট্য স্থির হয়ে থাকল। তারপর, ছুটোছুটি আর চিৎকার-চেচামেচি শুরু হতেই, গর্জে উঠল অস্ত্রগুলো।

দশটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে দোরগোড়ার দিকে ছুটল ঝাক ঝাঁক বুলেট। মাংস ভেদ করল, গুঁড়িয়ে দিল হাড় । বদ্ধ কামরার ভেতর গুলির আওয়াজ কামান দাগার মত প্রচণ্ড শোনাল।

এক মিনিট পুরো হবার আগেই থামল গুলি, তবে ইতিমধ্যে রাশিয়ান আর লিবিয়ান প্রতিনিধিদের ছ’জন বাদে বাকি সবাই হয় মারা গেছে নয়ত গুরুতর আহত হয়েছে । এতক্ষণে লিবিয়ান ট্রুপস আর সিকিউরিটি অফিসাররা তৎপর হলো ।

অ্যাসাসিনেশন স্কোয়াড অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, তাদের ট্রেনিংও খুব ভাল। দু’দলের বন্দুকযুদ্ধপ্রথম পর্বে স্থায়ী হলো পনের মিনিট, তাতে কামরার ভিতর তারা মারা গেল মাত্র তিনজন। বাকি সবাই বেরিয়ে গেল পিছনের ধাতব দরজা দিয়ে, কম্পাউন্ডের ভেতর যে যেখানে সুবিধা পেল আত্নরক্ষামূলক পজিশন নিল, দ্বিকীয় পর্বের যুদ্ধটা হলো এখানেই, স্থায়ী হলো মিনিট বিশেক, সব মিলিয়ে মারা গেল আরও বিশজন। সবশেষে দেখা গেল বহিরাগত টীমের দশজনের মধ্যে একজনও বেচে নেই।

পরদিন সকাল ন’টায় (জি. এম. টি.) টেলিফোন যোগে একটা মেসেজ পেল রয়টার। কয়েক মিনিটের মধ্যে সারা দুনিয়ার মিডিয়ার কাছে পৌছে গেল খবরটা । মেসেজে বলা হলো:

কাল খুব ভোর বেলা তিনটে হালকা প্লেন লিবীয়ার রাজধানী ত্রিপোলির অদূরে সুরক্ষিত মিলিটারি ট্রেড মিশন কমপ্লেক্সের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। রাডারকে ফাকি দেয়ার জন্যে প্রেনগুলো খুব নিচে দিয়ে আসে, কমপ্রেক্সের কাছাকাছি এসে বন্ধ করে দেয় এঞ্জিন। ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট অ্যাকশন আর্মি-র একটা একটিভ সার্ভিস ইউনিট কারও চোখে ধরা না পড়ে কমপ্নেক্সের ভেতর প্যারাস্যুট যোগে নেমে আসে। পরে, সোয়া ন’টার দিকে, ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাসিজম-এর পক্ষে এই ইউনিট বড় একটা শক্রদলের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে । শত্রুদের এই দলটা অশুভ
কমিউনিস্ট আদর্শ প্রসারের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, যা কিনা বিস্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার পরিপন্থী।

মহান কর্তব্যকর্ম নিষ্ঠার সাথে পালনকালে একটিভ ইউনিটের সদস্যরা মারা যাওয়ায় আমরা গর্বের সঙ্গে শোক প্রকাশ করছি। প্রসঙ্গ ক্রমে উল্লেখযোগ্য, এই ইউনিট আমাদের এলিট ফার্স্ট ডিভিশনের অংশ ছিল।

কমিউনিস্ট কোন দেশের সঙ্গে নন-কমিউনিস্ট দেশ বাণিজ্য বা মৈত্রী করলে এভাবে দ্রুত এবং নির্মম প্রতিশোধ নেয়া হবে । কমিউনিস্ট ব্লককে অবশিষ্ট মুক্ত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর ।

এন. এস. এ. এ.-র হাই কমান্ড থেকে প্রচারিত এই মেসেজকে যোগাযোগ নং- ১ হিসেবে অভিহিত করা হবে ।’

সে সময় একটা ব্যাপার কেউ খেয়াল করেনি বা খেয়াল করলেও অদ্ভুত বলে মনে করেনি। তা হলো, এন. এস. এ. এ. যে অন্ত্রগুলো ব্যবহার করেছে তার সবগুলোই সোভিয়েত রাশিয়ার তৈরি: ছ’টা কালাশনিকভ আর. পি. কে. লাইট মেশিন গান আর চারটে আর. পি. কে.-র ছোটভাই-হালকা, অত্যন্ত কাজের জিনিস, এ. কে. এম. অ্যাসল্ট রাইফেল । আসলে গোটা দুনিয়ায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ এত বেশি ঘটছে যে এধরনের অনেক খবরের ভিড়ে এই খবরটা তাৎপর্য হারিয়ে
ফেলে । মিডিয়া ধরে নেয়, এন. এস. এ. এ. ফ্যাসিস্ট ফ্যানাটিকদের ছোট একটা গ্রুপ।

এই ঘটনার প্রায় এক মাস পর, ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির পাঁচজন সদস্য ডিনারে আমন্ত্রন জানিয়েছেন সফররত সোভিয়েত কমিউনিস্ট তিনজন কর্মকর্তাকে । ডিনারে বসা হয়েছে ট্রাফাল্গার স্কয়ার-এর কাছাকাছি একটা বাড়িতে। সবেমাত্র কপি পরিবেশন করা হয়েছে, এই সময় কলিংবেলের আওয়াজ শুনে মেজবানকে টেবিল ছাড়তে হলো। ইতিমধ্যে রাশিয়ান অতিথিদের নিয়ে আসা ভোদকা উপস্থিত সবাই মনের সাধ মিটিয়ে খেয়েছেন।

সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা চারজন লোকের পরনে প্যারা-মিলিটারি ইউনিফর্ম, ব্রিপোলিতে যারা হামলা চালায় তাদের পরনেও ঠিক তাই ছিল।

এই ঘটনার প্রায় এক মাস পর ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির অত্যন্ত প্রভাবশালী এক সদস্য, নিজের দোরগোড়ায় গুলি খেয়ে মারা গেলেন। বাকি চারজন ব্রিটিশ ও তিনজন রাশিয়ানও মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিহত হলেন।

খুনিরা পালিয়ে গেল, পরেও তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

আটটা লাশের পোস্টমর্টেম করার সময় জানা গেল তারা সবাই রাশিয়ার তৈরি আগ্নেয়স্ত্রের গুলিতে মারা গেছেন। অস্ত্রগুলো সম্ভবত ম্যাকারভ অথবা স্টেচকিন অটোমেটিক পিস্তল ছিল। আমুনিশঙ্গুলো সনাক্ত করা সম্ভব হলো সেগুলোও রাশিয়ার তৈরি।

এন. এস. এ. এ। হাই কমান্ড থেকে যোগাযোগ নং-২ ইস্যু করা হলো পরদিন ন’টায় (জি. এম. টি)। এবার এক্টিভ সার্ভিস ইউনিটের নাম বলা হলো, ‘দ্যা এডলফ হিল্টার কমান্ডো’।

পরবর্তী বারো মাসে এ ধরণের আরও অন্তত ত্রিশটার মত ঘটনা ঘটল, এন. এস. এ. এ হাই কমান্ড এসব ঘটনার দায়িত্ব স্বীকার বা কৃতিত্ব দাবী করল।

পশ্চিম বার্লিন, বন, প্যারিস, ওয়াশিংটন, রোম, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন- পরবর্তীতে-মাদ্রিদ, মিলান, কাইরো, দিল্লী, ও যশোরে নামকরা কমিউনিস্টরা খুন হয়ে গেলেন, তাদের সঙ্গে মারা গেলেন ঘটনার সময় উপস্থিত সরকারী কর্মকর্তা বা বন্ধু-বান্ধবরা। যারা মারা গেলেন তাদের মধ্যে ব্রিটেন, যুক্তরাস্ট্র ও বাংলাদেশের তিনজন শ্রমিক নেতাও ছিলেন।

আসাসিনেশন ক্কোয়াড-এর সদস্যরাও অনেকে প্রাণ হারাল, তবে তাদের কাউকে আটক করা সম্ভব হলো না। চারটে ঘটনায় এন. এস. এ. এ. সদস্যরা গ্রেফতার এড়াবার জন্যে আত্মহত্যা করল।

আততায়ীদের প্রতিটি হামলা ছিল ক্ষিপ্র, অত্যন্ত সতর্ক ভাবে পরিকল্পিত, বজায় রাখা হয়েছে উচু খানের সামরিক শৃঙ্খলা ও দক্ষতা । প্রতিটি হামলার পর এন. এস. এ. এ.-র হাই কমাণ্ড থেকে যোগাযোগ নম্বর উল্লেখ করে মেসেজ পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি মেসেজে সংশ্লিষ্ট আকটিভ সার্ভিসের পরিচয় দেয়া হয়েছে-যেমন, ফাস্ট আইখম্যান কমান্ডো, হেনেরিক হিমলার এসএস ডিভিশন । এ-সব পুরানো নাম কুখ্যাত থাড রাইখ-এর কুৎসিত স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে মানুষকে । দুনিয়ার পুলিশ বাহিনী ও সিকিউরিটি সার্ভিস পাবার মধ্যে মাত্র এই একটাই সুত্র পেল। এন. এস. এ. এ. সদস্যদের লাশ থেকে, সে মেয়েই হোক বা ছেলে, কোন এভিডেন্স বা ক্লু পাওয়া যায়নি। তারা যেন হঠাৎ উদয় হয়েছে, পরিণত বয়স্ক, এন. এস. এ. এ.-র জন্ম। একটা লাশও সনাক্ত করা যায়নি। ফরেনসিক এক্সপার্টরা নগণ্য নমুনা নিয়ে
গলদঘর্ম হয়েছে, সিকিউরিটি এজেন্সিগুলো তাদের গুরুত্বহীন সূত্র ধরে তদন্ত চালিয়েছে, নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা ধরে খোজ-খবর নিয়েছে পুলিশ, কিন্তু কেউ কোন উপসংহারে পৌছুতে পারেনি । সামনে নিরেট পাচিল দেখে থেমে যেতে হয়েছে প্রত্যেককে ।

পশ্চিমা জগতের একটা দৈনিক একটা প্রতিবেদন ছাপল, দেখে মনে হলো উনিশশো চল্লিশ সালে তৈরি কোন সিনেমার পোস্টার :

‘অন্ধকার থেকে উদয় হয় তারা, খুন হয় কিংবা খুন করে,’ অথবা অদৃশ্য হয়ে যায়, কোথায় কেউ তা জানে না। কালো নাৎসী আমলের এই সহ অনুসারীরা কি তাহলে কবর থেকে উঠে আসে, সাবেক নেতাদের হয়ে প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে?
এতদিন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালিত হয়েছে বামপন্থী আদর্শবাদীদের দ্বারা, এখন নিজস্ব পদ্ধতি ও ঈর্ষণীয় দক্ষতার সাহায্যে এন. এস. এ. এ. সন্ত্রাসকে দিয়েছে ভীতিকর নতুন মাত্রা ৷

সিকিউরিটি ও ই্টেলিজেন্সের গোপন আর নিষিদ্ধ, রহস্যময় আর বিপজ্জনক জগতে অস্বস্তির সঙ্গে নড়েচড়ে উঠল লোকজন, যেন দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙছে তাদের, ভাঙার পর বুঝতে পারছে দুঃস্প্নটা সত্যি। ব্যাপারটা শুরু হলো দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময়ের মাধ্যমে । তারপর, সতর্কতার সঙ্গে, শুরু হলো তথ্য আদানপ্রদান। অবশেষে অদ্ভুত ও অপ্রত্যাশিত এক মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হলো তারা।


বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে যোগ দেয়ার পর থেকেই স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর বিশেষ পদ্ধতির সাহায্যে মাথার ভেতর টেলিফোন নম্বর জমা করে রাখতে অভ্যস্থ মাসুদ রানা । এখন ওর মাথায় এক হাজার বা কিছু কম লোকের ফোন নম্বর ফাইল করা রয়েছে, ইচ্ছে করলেই স্মরণ করতে পারবে । পেশা ও কাজ, এই শিরোনামের নিচেই বেশিরভাগ নম্বর, কাজেই কাগজে লিখে রাখার মধ্যে ঝুঁকি আছে।

লীনা পেকার পেশা বা কাজ নয়। লীনা শুধুই খেলা আর ফুর্তি।

হেলসিংকির উত্তরপ্রান্তে হোটেল শেরাটনের একটা কামরায় রয়েছে রানা, বিছানায় শুয়ে ডায়াল করছে। অপরপ্রান্তে দু’বার রিঙ হলো, রিসিভার তুলে ফিনিশ ভাষায় কথা বলল এক তরুণী ।

রানা ইংরেজিতে বলল, “লীনা পেকার, প্লীজ ।”

ফিনিশ অপারেটর এবার ইংরেজিতে জানতে চাইল, “কি পরিচয় দেব
আপনার?’

“আমার নাম রানা, মাসুদ রানা ।’

‘এক মিনিট, মি. রানা । আমি দেখছি মিস পেকারকে পাওয়া যায় কিনা ।’

কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে হলো রানাকে । তারপর ক্রিক করে শব্দ হলো একটা । কানে ভেসে এল পরিচিত মিষ্টি জলতরঙ্গের আওয়াজ, “রানা? রানা, তুমি কোথায়?’ যত মেয়েকে চেনে রানা, লীনার মত মধু কারও গলায় নেই।

রানা বলল, শেরাটনে রয়েছে ও।

‘এখানে? এখানে, হেলসিষ্কিতে?’ লীনার আনন্দ গোপন থাকছে না।

‘হ্যা” আশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল রানা, “এখানে, হেলসিষ্কিতে, ফিনএয়ার যদি ভুল জায়গায় নামিয়ে না থাকে।’

“ফিনএয়ার ঘরমুখো পায়রার মত, আনন্দে উচ্ছ্বাসে হেসে উঠল লীনা । “ভুল জায়গায় খুব কমই নামে ওরা। কিন্তু একি সারপ্রাইজ! তুমি আমাকে বলোনি কেন যে আসছ?

“নিজেও ছাই জানতাম নাকি, মিথ্যে কথা বলল রানা । “হঠাৎ প্ল্যান বদল আর কি।’ এটা অবশ্য সত্যি কথা । “হেলসিষ্কি হয়ে যেতে হচ্ছে, তাই ভাবলাম একবার থামি। বলা যায় ঝোকের মাথায় ।’

“ঝোক?’

“খেয়াল। হঠাৎ পাগলামি । হেলসিষ্কির ভেতর দিয়ে যাব, অথচ লীনা বিউটিফুলকে দেখব না, তা কিভাবে সম্ভব!”
হেসে উঠল লীনা, খুশি করার জন্য নয়, খাটি জিনিস। কল্পনার চোখে রানা দেখতে পেল, হাসির দমকে লীনার মাথাটা পিছন দিকে ঝাঁকি খেল, মুখ খোলা, ভেতরে দেখা যাচ্ছে মুক্তোর মত দাত আর লালচে জিভ । যত মেয়েকে চেনে রানা,
লীনার মত প্রাণচঞ্চল কেউ নয়।

“আজ রাতে তুমি ব্যস্ত নাকি?’ জানতে চাইল রানা । ওকে পাওয়া না গেলে সন্ধেটা একেবারে বরবাদ হয়ে যাবে।

“সাংঘাতিক ব্যস্ত, আবার সেই হৃদয় দোলানো হাসি হাসল লীনা । “এমন একটা দিনে এলে!’

“ও |” হতাশা চেপে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করল রানা।

“মন খারাপ, রানা?

‘তুমি তাহলে ফ্রী হবে কখন?

শুধু আজ রাতে নয়?

“ডিয়ার গড, আমার হিরো রসিকতাও বোঝে না!’ আবার খিল খিল করে হেসে উঠল লীনা । তারপর হাসি থামিয়ে বলল, “এতদিনের পরিচয়, এখনও তুমি জানো না তোমার জন্যে কি না করতে পারি আমি!”

আজ প্রায় পাচ বছর হলো পরস্পরকে চেনে ওরা । প্রথমবার দেখা হয়েছিল লন্ডনে।
সময়টা ছিল বসন্তকাল, যখন অফিসের মেয়েগুলোকে দেখে মনে হয় কাজে যেতে খুব আনন্দ লাগছে তাদের, পার্কগুলোয় যখন ড্যাফোডিল হলুদ কার্পেট বিছিয়ে রাখে।

দিনগুলো তখন সবে লম্বা হতে শুরু করেছে । বাংলাদেশ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একদল উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি ব্রিটিশ প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে এসেছে। ঘটনাচক্রে ফিনন্যাণ্ডের বাণিজ্যমন্ত্রীও সে-সময় লণ্ডনে। যোগাযোগ হলো
টেলিফোনে, বাংলাদেশ ও ফিনিশ দূতাবাসের মধ্যে । ফিনিশ দূতাবাস জানাল, বাংলাদেশ থেকে পাট কেনার ব্যাপারে আলোচনা করতে চায় তারা । তাদের বাণিজ্যমন্ত্রী যেহেতু লগুনে রয়েছেন, আলোচনায় একমত হওয়া গেলে একটা চুক্তিও হতে পারে। এরকম একটা সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না ভেবে বাংলাদেশ বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের নেতা তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। তারপরই ফিনিশ ও বাংলাদেশ দূতাবাসে এক লোক টেলিফোন করে জানাল, পাট নিয়ে কোন আলোচনা শুরু করলে প্রতিনিধিদের গুলি করে মারা হবে।

পাট নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বহুকালের পুরানো। একটা কুচক্রী মহল সব সময় তৎপর ৷ বোঝা গেল, আলোচনায় তারাই বাদ সাধতে চাইছে। বাংলাদেশ ও ফিনিশ দূতাবাস থেকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে ব্যাপারটা
জানানো হলো । স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তদন্ত শুরু করল বটে, তবে সেই সঙ্গে পরামর্শ দিল আলোচনা বৈঠকে না বসাই ভাল ।

বিসিআই হেডকোয়ার্টার ঢাকায় বসে টেলিফোনে খবরটা পেয়ে রেগে গেলেন মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খান। তিনি বাংলাদেশ দূতাবাসকে নিরাপত্তার দিকটা দেখবে রানা এজেন্সি। ভাগ্যক্রমে সে-সময় লন্ডনেই ছিল রানা ।
রানা যেন নিজে ওখানে উপস্থিত থাকে।

পেশাগত দুষ্টিত রানার ‘আ্যাসাইনমেন্ট’-টা ছিল ঘটনাবিহীন, কারণ টেরোরিস্টরা হুমকি দিলেও তাদের কাউকে দূতাবাসের ধারেকাছে দেখা যায়নি। সেবার ফিনল্যাণ্ডের সঙ্গে পচিশ কোটি ডলারের পাট রফতানির একটা চুক্তি হয়
বাংলাদেশের । দেশের লাভ হয়েছে, সন্দেহ নেই । আর লাভ হয়েছে রানার । হ্যা, লাভই তো-লীনা পেকার রানার জীবনে বিরাট একটা লাভ।
লোকজন ভর্তি কামরার ভেতর লীনাকে প্রথমবারই দেখে ফেলে রানা, সেজন্য শুধু তার রূপযৌবন দায়ী নয়, কামরার ভেতর মেয়ে বলতে একমাত্র সে-ই ছিল। এডভার্টাইজিং কোম্পানীর প্রতিণিধি হিসেবে ওই একজনকেই দেখা গেছে।
লীনাকে দেখার আগে একটা তালিকায় তার নাম আগেই দেখেছিল রানা ।

সাদা পোশাকে পরীর মত লাগছিল তাকে। প্রথমদর্শনেই রানার ভাল লেগে যাবার কারণ হলো, মেয়েটার চোখ আর চুল কুচকুচে কালো । তার চুল কাধের কাছে স্তূপ হয়ে আছে, অসম্ভব ঘন ও ভারি, যেন ঝড়ের মধ্যেও এলোমেলো হবে
না। রোগা-পাতিলা একহারা গড়ন, চোখ দুটো বিশাল, দেহভঙ্গিমায় উপচে পড়ছে লাবণ্য । আর ঠোট জোড়ার এমন আকৃতি, ওগুলোর একটাই যেন উদ্দেশ্য ।

লীনাকে দেখে প্রথমেই পেশাগত একটা চিন্তা খেলে যায় রানার মাথায়। কী সাংঘাতিক একটা টোপ বা ফাদ হতে পারে মেয়েটা । ওর জানা ছিল, ভাল টোপ বা ফাদ পাওয়া ফিনল্যাণ্ডে একটা সমস্যা ৷ বেশ অনেকক্ষণ দূরে সরে থাকে রানা, বুঝে নিতে চায় মেয়েটা একা এসেছে কিনা । তারপর এগোয় ও, নিজের পরিচয় দেয়, জানায় তাদের বাণিজ্যমন্ত্রী স্বয়ং তার ওপর খেয়াল রাখার জন্যে অনুরোধ করেছেন ওকে।

দু’বছর পর, রোমে, লীনা রানাকে বলেছে, সেদিন লণ্ডনে সারাটা বিকেল বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেই তার মন জয় করার চেষ্টা চালান, মিসেস মিনিস্টারের অনুপস্থিতিতে ।

সেবার লীনা লন্ডনে ছিল এক হপ্তা । প্রথমদিন গভীর রাতে লীনাকে রিজ-এ নিয়ে যায় রানা কফি খাওয়ানোর জন্যে । রিজ-এর পরিবেশ লীনার কাছে ‘নীরস’ লাগে। নিজের হোটেলে রানাকে কনুইয়ের গুতো মারে সে, বেমক্কা ।

লীনা প্রত্যাখ্যান করায় একটা জেদ চেপে যায় রানার মনে । এরপর মেয়েটাকে প্রভাবিত করার চেস্টা চালায়। ডরচেস্টার, স্যাভয়, রয়্যাল গার্ডেন রুফ, দা ইন ইত্যাদি সব নামকরা হোটেল-রেস্তোরায় রানার সঙ্গে গেছে ঠিকই লীনা, তবে রোমাঞ্চিত বা পুলকিত করা যায়নি তাকে । বিনীত ভঙ্গিতে রানাকে সে জানিয়েছে, এ-সব জায়গায় আগেও বহুবার এসেছে সে, কাজেই তার পক্ষে মুগ্ধ হবার ভান করা সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত এমন হলো, লন্ডন শহরে ভাল কোন হোটেল-রেস্তোরা আর বাকি থাকল না। কিন্তু তারপরও মেয়ে টলে না। এবার রেগে গেল রানা, হিলটন থেকে ডিনার খেয়ে লীনাকে তার ফ্ল্যাটে পৌছে দেয়ার সময় বলল, “তবে কি তোমার আশা আমাকে ছেড়ে দিতে বলো?’

এই প্রথম বিস্ফোরিত হয় জলতরঙ্গ । খিলখিল করে হেসে ওঠে লীনা । হাসি
থামতে বলে, ‘এরজন্যেই এতদিন অপেক্ষা করছিলাম । কবে তুমি রাগবে!

অত্যন্ত দ্রুত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠল ওরা । সমান আগ্রহ আছে এমন সব বিষয় আবিষ্কারের খেলায় মেতে উঠল। দু’জনেই ওরা সেইলিং, জাজ আর এরিক আ্যাম্বলারের লেখা ভালবাসে । আরেকটা খেলার সাংঘাতিক ভক্ত ওরা, সেটা খেলা
হলো পাঁচ দিনের দিন। তুখোড় খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত রানা, স্বীকার করল, লীনা তার চেয়েও ভাল, সোনার মেডেল পাবার উপযুক্ত । আর লীনা বলল, কিছু ক্রটি-বিচ্যুতি কাটিয়ে উঠতে পারলে রানা হতে পারে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ । যদিও এ-ব্যাপারে রানার নিজের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। প্রতিষ্ঠিত করেছে ওরা । মাঝে মধ্যেই দেখা হয়, বেশিরভাগ সময় ঘটনাচক্রে । নিউ ইয়র্ক, প্যারিস, মিউনিক, এ-সব জায়গায় । গত বছর শেষ দেখা হয়েছে ব্রাসেলসে, গরমে । আজ রাতে হৈলসিষ্কিতে, অর্থাৎ লীনার নিজের উঠানে এই প্রথম ওদের দেখা হতে যাচ্ছে।

“ডিনার? জানতে চাইল রানা।

‘রেস্তোরাঁটা যদি আমার বাছাই করার সুযোগ থাকে।’

তুমিই কি সবসময় বাছো না?

“তুমি আমাকে তুলে নিতে চাও?

“তা তো চাইই, আরও কিছু চাই ।’

“আমার ফ্ল্যাটে । সাড়ে ছ’টায়? তোমার কাছে ঠিকানা আছে?’

“হৃদয়ে খোদাই করা, সুন্দরী ।’

‘এ-কথা তুমি সব মেয়েকেই বলো ।’

“বলি, যদি তারা সত্যি সুন্দরী হয়। অর্থাৎ, এ-ব্যাপারে আমি আন্তরিক ও সৎ।……………………

সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top