একটু চোখ বুলিয়ে নিন
এক
সময়: খিস্টপূর্ব ৭১২০ সাল। স্থান: আজ সবাই যে জায়গাটাকে কানাডার হাডসন বে বলে জানে।
বিপদটা এল অনেক দূর থেকে । আকাশ থেকে পড়া একটা বস্তু, বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের মতই পুরানো, স্পষ্ট কোন আকৃতি নেই; অনন্ত নীলিমার মহাগহ্বরে বিপুল বরফ, পাথর, ধুলো আর গ্যাস দিয়ে তৈরি হয়েছে চারশো কোটি ষাট লক্ষ বছর আগে, সৌরজগতের দূরবর্তী গ্রহগুলো যখন জন্ম নিচ্ছিল ছড়ানো কণাগুলো ঠাণ্ডায় জমে এক মাইল ডায়ামিটারের নিরেট পিন্ডে পরিণত হওয়া মাত্র মহাকাশের মহাশুন্যতার ভিতর দিয়ে নিঃশব্দে শুরু হলো ওটার নিজস্ব কক্ষপথ ধরে ভ্রমণ; এখন ওটা দুরবর্তী সূর্যকে এক পাক ঘুরে আসবে, তারপর আবার আরও দূরের কয়েকটা নক্ষত্রের দিকে রওনা হয়ে পাড়ি দেবে কমবেশি অর্ধেক পথ, প্রতিবার আসা আর যাওয়ায় পেরিয়ে যাবে কয়েক হাজার বছর ।
ধূমকেতুটির মজ্জা বা নিউক্লিয়াস হলো জমাট পানি, কার্বন মনোক্সাইড, মিথেন গ্যাস আর মেটালিক রক-এর এবড়োখেবড়ো টুকরো । তুষারের তৈরি নোংরা একটা বল বলা যেতে পারে, ঈশ্বরের হাত ছুঁড়ে দিয়েছে মহাশূন্যে । “তবে সূর্যটাকে চক্কর দিয়ে ফিরতি পথ ধরার সময় ওটার নিউক্লিয়াস সোলার রেডিয়েশনের সংস্পর্শে রিয়্যাক্ট করলে আশ্চর্য একটা রূপান্তর ঘটতে দেখা যায নোংরা কদাকার ধূমকেতুটি হয়ে ওঠে বিস্ময়কর সৌন্দর্যের
আধার ।
সূর্যের উত্তাপ আর আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি শোষণ করার সময় ওটার গায়ে লম্বা একটা কমা চিহ্ন তৈরি হয়, ধীরে ধীরে সেটা হয়ে ওঠে প্রকাণ্ড একটা আলোকিত লেজ, বাকা রেখার মত সেই নীল লেজ নিউক্লিয়াসের পিছনে নয় কোটি মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। তৈরি হয়, দশ লাখ মাইল লম্বা, বড় লেজটির কিনারা থেকে পাক খেয়ে বেরিয়ে আসে মাছের পাখনার মত ।
প্রতিবার সূর্যকে পাশ কাটাবার সময় ধূমকেতুটি কিছুটা করে বরফ হারায়, ফলে নিউক্লিয়াস ছোট হতে থাকে। পরবর্তী দুই কোটি বছরে, সব বরফ খুইয়ে ভেঙে পড়বে ওটা, পরিণত হবে ধুলোর মেঘ আর ছোট উক্কারাশিতে ৷ ভবিষ্যতে আর কখনও ওটা সৌর জগতের বাইরে থেকে চক্কর দিয়ে আসবে না বা পাশ কাটাবে না সূর্যকে। কপালের লিখন দূর মহাশুন্যের কালো অন্ধকারে ধীরে ধীরে মৃত্যুরবণ করা নয়, ওটার জীবন-প্রদীপ নিভে যাবে অতি দ্রুত মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে । তবে এবার, চলতি কক্ষপথ ভ্রমণের সময়, বৃহস্পতি গ্রহকে নয় লাখ মাইল দূর থেকে পাশ কাটিয়ে আসায় দেখা দিয়েছে একটা বিপত্তি। বৃহস্পতির প্রচন্ড মহাকর্ষ শক্তি নিজের পথ থেকে খানিকটা সরিয়ে দিয়েছে ওটাকে । নতুন পথটি সোজা চলে গেছে সূর্যের তৃতীয় গ্রহের দিকে। ফলে একটা সংঘর্ষ ঘটতে যাচ্ছে।
তৃতীয় ওই গ্রহটির বাসিন্দারা নিজেদেরকে মানুষ বলে। গ্রহটাকে বলে পৃথিবী ।
পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ থেকে ঘন্টায় এক লক্ষ ত্রিশ মাইল গতিতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আছড়ে পড়ল ওটা, মাধ্যাকর্ষণের কারণে প্রতি মুহূর্তে গতি আরও বাড়ছে। দশ মাইল চওড়া, কাপা কাপা একটা আভা ছড়িয়ে পড়ল । তারপরই চার শো কোটি টন ওজনের ধূমকেতু তার অসম্ভব গতির কারণে বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘষা খেয়ে ভাঙতে শুরু করল । সাত সেকেন্ড পর প্রচণ্ড একটা অগ্নিকৃণ্ডে পরিণত হলো ওটা, ভয়াবহ বিধ্বংসী শক্তি নিয়ে আঘাত করল পৃথিবীর বুকে । গতি থেকে উৎসারিত শক্তির বিস্ফোরণে পানি আর মাটি বাম্প হয়ে উড়ে যাওয়ায় তৎক্ষণাৎ যে গহ্বরটি তৈরি হলো তার ভিতর দশটা সেইন্ট মার্টিন দ্বীপ ঢুকে যাবে।
প্রচণ্ড এক সাইজমিক শকে নড়ে উঠল পৃথিবী, মাপার উপায় থাকলে ১২.০ মাত্রার ভূমিকম্পের সমান বলে দাবি করা যেত, যদিও রিখটার স্কেলে মাত্র ৮ পর্যন্ত মাপার ব্যবস্থা আছে-সেটাও আবিষ্কার হতে এখনও সাত হাজার বছর বাকি। কয়েক মিলিয়ন টন পানি, তলানি আর আবর্জনা বিস্ফোরিত হলো উপর দিকে। বায়ুমণ্ডলে বিরাট এক গর্ত তৈরি হয়েছে, সেটা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে বৃষ্টির মত আবার নীচে পড়ার সময় ওগুলোর সঙ্গী হলো কয়েক মিলিয়ন টন খণ্ড-বিখন্ড পাথর, জ্বলন্ত উল্কা। খেপা একটা অগ্নিঝড় দুনিয়ার সমস্ত বনভূমি ধ্বংস করে দিল। হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরি হঠাৎ করে বিস্ফোরিত হলো, তরল লাভার সাগর ডুবিয়ে দিল লক্ষ লক্ষ বর্গমাইল এলাকা । বায়ুমণ্ডলে এত বেশি ধোয়া আর জঞ্জাল ছড়িয়েছে যে, প্রায় এক বছর পৃথিবীর কোথাও থেকে সূর্যকে দেখা গেল না, ফলে তাপমাত্রা নেমে এল শূন্য ডিগ্রির নীচে, সেই সঙ্গে-পৃথিবী ডুব দিল গভীর অন্ধকারে ৷ দুনিয়ার প্রতিটি কোণে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটল অবিশ্বাস্য দ্রতবেগে । বরফ ঢাকা বিশাল সব প্রান্তরে আর উত্তরের সমস্ত
হিমবাহর তাপমাত্রা বেড়ে দাড়াল নব্বুই থেকে একশো ডিগ্রি ফারেনহাইট, ফলে ধা-ধা করে গলে গেল বরফ গ্রীম্মপ্রধান আর নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় বেড়ে ওঠা জীবজন্তু আর পশুপাখি রাতারাতি বিলুপ্ত হয়ে গেল। অনেক প্রাণী, যেমন হাতি, গরমকালের উষ্ণতায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় জমে গেল বরফের মত, পাতা আর ফুল এখনও হজম হয়নি পেটে । একই অবস্থা হলো গাছগুলোরও । সংঘর্ষের ফলে সাগর থেকে যে-সব মাছ উপর দিকে ছুটে গিয়েছিল সেগুলো কালো হয়ে ওঠা আকাশ থেকে কয়েকদিন ধরে ঝরে পড়ল ।
পাচ থেকে দশ মাইল উচু ঢেউ আছড়ে পড়ল মহাদেশগুলোর উপর । তটরেখা বদলে গেল, ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল সমস্ত কল্পনাকে । নিচু উপকূলীয় এলাকা ডুবিয়ে দিয়ে কয়েকশো মাইল ভিতরে ঢুকে পড়ল পানি, সামনে যা কিছু পেল সব ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। নিচু এলাকা ঢাকা পড়ে গেল সাগরতল থেকে উঠে আসা আবর্জনা আর তলানিতে ৷ বিপুল জলরাশি শুধু পাহাড়ের গোড়ায় বাধা পেয়ে থমকাল. তারপর ধীরগতিতে ধরল
ফিরতি পথ । তবে ফেরার সময়ও কিছু কম দেখাল না-বহু নদীর পথ বদলে দিল, আগে যেখানে ছিল না সেখানে দেখা গেল সাগর তৈরি হয়েছে, বড় বড় অনেক লেক পরিণত হয়েছে মরুভূমিতে ।
চেইন রিয়্যাকশন যেন থামবে না!
বিরতিহীন গুরুগন্তীর চাপা গর্জন তুলে বাতাস লাগা নারকেল গাছের মত নুয়ে পড়ছে পাহাড়গুলো, ঢাল বেয়ে নেমে আসছে পাথর ধস। সাগর আর সমুদ্র উঠে আসায় মরুভূমি আর খোলা প্রান্তর ডুবে গিয়েছিল, পাহাড়ের গোড়ায় বাধা পেয়ে সেই বিপুল জলরাশি ফুলে উঠল, তারপর আবার বিধ্বংসী শক্তি নিয়ে ফিরতি পথ ধরল । ধূমকেতু আঘাত করার ফলে ভূ-ত্ক অকস্মাৎ বিপুল পরিমাণে স্থান্চ্যুত হয়েছে । বাইরের স্তর (প্রায় চল্লিশ মাইল পুরু)
আর তপ্ত তরল মজ্জার উপর বিছিয়ে থাকা আবরণ তুবড়ে আর মুচড়ে গেল। যেন অদৃশ্য কোন হাতের কারসাজিতে সবটুকু ভূ-ত্বক একটা ইউনিট হয়ে নড়ে উঠল ।
সবগুলো মহাদেশকে ঠেলে দেওয়া হলো নতুন লোকেশনে । নিচু পাহাড় উঁচু হয়ে বিরাট পর্বতে পরিণত হলো। প্রশান্ত
মহাসাগরের পুরানো সমস্ত দ্বীপ গায়েব হয়ে গেল, সেগুলোর বদলে মাথাচাড়া দিল নতুন সব দ্বীপ । অ্যান্টার্কটিকা আগে ছিল চিলির পশ্চিমে, জায়গা বদলে সরে গেল দু’হাজার মাইল দক্ষিণে, ক্রমে বেড়ে ওঠা বরফের মোটা চাদরে দ্রুত ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমে ভারত মহাসাগরের পানিতে প্রচুর বরফ ভেসে থাকত, আবহাওয়া গরম হয়ে ওঠায় সে-সব গলে গেল। একই পরিণতি হলো সাবেক উত্তর মেরুরও. যেটার বিস্তার ছিল গোটা উত্তর কানাডা জুড়ে । নতুন মেরু প্রদেশ বরফের মোটা স্তর উৎপাদন শুরু করল এমন এক জায়গায় যেখানে আগে ছিল খোলা
সমুদ্র ।
প্রকৃতি আর আবহাওয়ার খিচুনি, মোচড়, আক্ষেপ আর বিক্ষেপ বিরতিহীন চলতেই থাকল, এ যেন কোনদিন আর থামবে না। পৃথিবীর মোটা বাইরের স্তরের স্থানচ্যুতি একের পর এক প্রলয়ঙ্করী ঘটনার জন্ম দিল। আগের আইস ফিল্ড অকস্মাৎ গলে গেছে, সেই সঙ্গে প্রায় সমস্ত হিমবাহ গ্রীম্মপ্রধান এলাকায় সরে যাওয়ায় সাগরগুলোর উচ্চতা চারশো ফুট বেড়ে গেল, ধূমকেতুর সংঘর্ষে তৈরি টাইডাল ওয়েভে আগেই বিধ্বস্ত বিশাল এলাকা ডুবে গেল নতুন করে । শুকনো খটখটে একটা প্রান্তর ব্রিটেনকে জুড়ে রেখেছিল সমগ্র ইউরোপ মহাদেশের সঙ্গে, মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার
ব্যবধানে সেটা এখন একটা দ্বীপ; একই সময়ে একটা মরুভূমি, প্লাবনে ডুবে গেল। নীল নদের প্রবাহ অসংখ্য উপত্যকাকে উর্বরতা দান করছিল, তারপর পশ্চিমে এগিয়ে সমুদ্রে গিয়ে মিশেছিল, কিন্তু এখন সেটা থেমে গেল হঠাৎ গজানো ভূমধ্যসাগরে ।
সর্বশেষ বরফ যুগের শুরু ও শেষটা এরকমই ছিল ।
দুনিয়া জুড়ে সমুদ্রের অবস্থান ও প্রবাহে নাটকীয় পরিবর্তন আসায় পৃথিবীর আহ্নিকগতির ভারসাম্যে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হলো। পৃথিবীর অক্ষ সাময়িকভাবে দুই ডিথ্বি সরে গেল, কারণ উত্তর আর দক্ষিণ মেরু স্থানচ্যুত হয়ে নতুন ভৌগোলিক অবস্থানে চলে গেছে, ফলে ভূমণ্ডলের চারপাশের সেন্ট্রিফিউগল গতিতে পরিবর্তন ঘটল । তরল হওয়ায়, পৃথিবী আরও তিনটে আবর্তন শেষ করার আগেই, পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদেরকে মানিয়ে নিল সাগরগুলো। কিন্তু ভূমি অত দ্রুত রিয়্যাক্ট করতে পারল না। ভূমিকম্প চলতে থাকল মাসের পর মাস।
নির্দয় হিংস্র ঝড় দাপিয়ে বেড়াল চরাচর, পরবর্তী আঠারো বছর মাটিতে যা কিছু দাড়িয়ে ছিল সব ভেঙ্চুরে গুঁড়ো করে ফেলল । তারপর বন্ধ হলো দুই মেরুর কাপন, অক্ষদণ্ডের নতুন নিয়মে বাধা ঘৃর্ণনের সঙ্গে মানিয়ে নিল নিজেদেরকে । এক সময় সাগরের লেভেল স্থির হলো, ফলে নতুন তটরেখা তৈরি হতে আর কোন বাধা থাকল না, সেই সঙ্গে আবহাওয়া আর জলবায়ু ক্রমশ স্বাভাবিক হতে থাকল । তবে পরিবর্তনগুলো হয়ে গেল স্থায়ী ।
রাত আর দিনের মাঝখানে সময়ের ক্রম বদলে গেল, বছর থেকে কমে গেল দুটো দিন। পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ডও বিপর্যস্ত হলো, উত্তর-পশ্চিমে সরে গেল একশো মাইলেরও বেশি ।
কয়েকশো, কিংবা হয়তো কয়েক হাজার বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্ত আর মাছ তৎক্ষণাৎ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দুই আমেরিকা মহাদেশ থেকে এক কুঁজ বিশিষ্ট উট, হাতি, ঘোড়া আর দৈত্যাকার স্লোথ হারিয়ে গেল। অদৃশ্য হলো দাতাল বাঘ, ডানার পঁচিশ ফুট বিস্তার নিয়ে প্রকাণ্ড পাখি, আর একশো বা তারও বেশি পাউন্ড ওজনের জীবজন্ত; বেশির ভাগ মারা গেল ধোয়া আর আগ্নেয়গিরি থেকে বেরিয়ে আসা গ্যাসে দম আটকে ।
আগুনে পুড়ে নিঃশেষ হয়নি যে-সব গাছপালা আর গুল্ম-লতা, সেগুলো মারা গেল রোদের অভাবে । সব শেষে দেখা গেল পৃথিবীর সব ধরনের প্রাণের শতকরা পঁচাশি ভাগ নিঃশেষ হয়েছে প্লাবন, অগ্নিকাণ্ড, ঝড়, পাথর-ধস আর বায়ুমণ্ডলে ছড়ানো বিষে ।
মানব সমাজ ছিল কোথাও কোথাও অত্যন্ত উন্নত আর প্রগতিশীল, অসংখ্য সমৃদ্ধ সংস্কৃতি স্বর্ণযুগে প্রবেশের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিল-মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সে-সব নিশ্চিহ হয়ে গেল পৃথিবীর বুক থেকে । দুনিয়ার লক্ষ কোটি মানুষ-পুরুষ, নারী ও শিশু শিকার হলো বীভৎস মৃত্যুর । বৈচিত্র্যময় যে-সব সভ্যতা বিকশিত হতে যাচ্ছিল, সেগুলোর চিহৃমাত্র রইল না; অল্প কিছু মানুষ ভাগ্যগুণে প্রাণে বেচে গেলেও ঝাপসা স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই থাকল না তাদের । হঠাৎ ধ্বংস হয়ে গেছে দশ হাজার বছরের পুরানো সভ্যতা। রাজআ-রানি, আর্কিটেক্ট, রাজমিস্ত্রি, শিল্পী আর বীরযোদ্ধারা হারিয়ে গেছে চিরকালের জন্য । তাদের কীর্তি আর ব্যক্তিগত সম্পদ নতুন সাগরের গভীর তলদেশে হারিয়ে গেছে; প্রাচীন সেই সভ্যতার হয়তো অল্প কিছু নমুনা এখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকতে পারে।
নগণ্য সংখ্যক কিছু মানুষ বেচে যায় সময়মত উচু পাহাড়ী এলাকায় উঠে আসতে পেরেছিল বলে । পাথুরে গুহায় আশ্রয় নিয়ে দুনিয়াজোড়া মহা আলোড়ন থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করে তারা৷ তাদের এই সময়টাকে নতুন একটা অন্ধকার যুগ বলা যেতে পারে, স্থায়ী হয়েছিল দুই হাজার বছর । ধীরে ধীরে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে মানুষ, দালান-কোঠা বানাতে শুরু করে, মেসোপটেমিয়া আর মিশরে আবার গড়ে তোলে শহর ও সভ্যতা ।
তবে সেই প্রাচীন সভ্যতার বেঁচে যাওয়া মুষ্টিমেয় কিছু প্রতিভাবান ব্যক্তি যারা সৃষ্টিশীল চিন্তাধারার অধিকারী ছিল, নিজেদের সভ্যতা চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে বুঝতে পেরে প্রকাণ্ড আকারের পাথরকে বিভিন্ন আঙ্গিকে সাজিয়ে পরবর্তী সভ্যতাকে কিছু বার্তা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। সে-সব বার্তায় আভাস দেওয়া হয়েছে কেমন ছিল তাদের সভ্যতা, কীভাবে তা ধ্বংস হলো; বিপদটা যে আবার আসতে পারে সে-ব্যাপারেও সতর্ক করা হয়েছে।
এত মৃত্য আর সর্বনাশ ধ্বংসকাণ্ডের জন্য দায়ী নোংরা বরফের একটা তাল বা স্তুপ, আকার-আয়তনে মাঝারি একটা মফস্বল শহরের চেয়ে বড় নয়। ধূমকেতুটি পৃথিবীর বুকে আক্ষরিক অর্থে মরণ আঘাত হেনেছিল। এরকমই আঘাত হেনেছিল একটা উল্কাপিন্ড, ছয় কোটি পঞ্চাশ লক্ষ বছর আগে। সেবার দুনিয়ার বুক থেকে ডায়নোসররা নিশ্চিহ্ হয়ে যায় ।
ধূমকেতুকে ঘিরে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের মধ্যে অনেক কুসংস্কার জন্ম নিয়েছে। ভূমিকম্প, ঝড়, বন্যা, খরা, মহামারী থেকে শুরু করে যুদ্ধ পর্যন্ত সমস্ত কিছুর জন্য ধূমকেতুকে দায়ী করা হত। তবে আধুনিক যুগের মানুষ বুঝতে শিখেছে ধূমকেতু স্রেফ প্রকৃতির একটা বিস্ময় মাত্র, বিচিত্র রওধনু বা অস্ত-গামী সূর্ষের দ্বারা সোনালি রং করা মেঘের মত ।
প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে যে কল্পিত প্লাবন আর অন্যান্য দুর্যোগের কথা বলা হয়েছে, এই একটি মর্মান্তিক ঘটনার সঙ্গে সবগুলো একই সুতোয় গাথা । প্রাচীন সভ্যতা, যেমন সেন্ট্রাল আমেরিকার ওলমেকস্, মায়ান আর আ্যাজটেক সভ্যতারও বেশ কিছু কিংবদত্তিতে সর্বনাশা মহা আলোড়ন বা বিপর্যয়ের কথা বলা হয়েছে। গোটা আমেরিকা জুড়ে ইন্ডিয়ান আদিবাসীদের মধ্যে বংশপরস্পরায় প্রচলিত গল্পে জানা যায় বিপুল পানি এসে তাদের
এলাকা ডুবিয়ে দিয়েছিল । চিনা আর আফিকানরাও প্রাবনের কথা বলে।
তবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে কিংবদন্তি সারা দুনিয়ার লোকের মুখে মুখে শোনা গেছে, সৃষ্টি করেছে গভীর রহস্য আর কৌতুহল, সেটা হলো হারানো সভ্যতা-আটলান্টিস।
দুই
সেপ্টেম্বর ৩০, ১৮৫৮।
স্টেফ্যানসন বে, এন্টার্কটিকা।
লিলিয়ানা ফ্লেচার জানে, হাটা বন্ধ করলে নির্ঘাত মারা যাবে । ক্লান্তির প্রায় চরমে পৌছে গেছে, এগোচ্ছে শুধু প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে । তাপমাত্রা শুন্য ডিগ্রির চেয়ে অনেক নীচে, তবে কাপড়চোপড় ভেদ করে গায়ের চামড়ায় কামড় বসাচ্ছে ঝড়ো বাতাসের ধারাল দাঁত। মারাত্মক ঝিমুনির ভাব আলগোছে গ্রাস করছে তাকে, ধীরে ধীরে কেঁড়ে নিচ্ছে বেঁছে থাকার আকাঙ্ক্ষা। যন্ত্রচালিত পুতুলের মত থেমে থেমে এগোচ্ছে সে । আইস ফিল্ডের খাজে বা ফাটলে পা বেধে যাওয়ায় হোচট খাচ্ছে প্রায়ই । নিঃশ্বাস ফেলছে দ্রুত, যেন অক্সিজেন ইকুইপমেন্ট ছাড়াই হিমালয়ের চুড়ায় ওঠার চেষ্টা করছে কোনও পর্বতারোহী
দৃষ্টিসীমা না থাকারই মত, কারণ প্রবল বাতাসের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে তুষার কণার তৈরি প্রায় নিশ্ছিদ্র মেঘ! ফার দিয়ে কিনারা মোড়া পারকা পরে আছে লিলিয়ানা, তার ভিতরে উলের তৈরি একটা স্কার্ফ মুখটাকে জড়িয়ে রেখেছে । সেই স্কার্ফের ভিতর থেকে চোখ দুটোকে খুব কমই বের করছে সে, তা সত্ত্বেও তুষার কণার আঘাত লেগে ফুলে উঠেছে ওগুলো, রঙ হয়ে উঠেছে টকটকে লাল । আরেকবার তাকাতে হতাশায় ছেয়ে গেল মনটা. কারণ ঝড়ের উপরে ঝলমলে নীল আকাশ আর চোখ ধাধানো’ সূর্য দেখতে পেল সে। পরিচ্ছন্ন আকাশের নীচে অন্ধ করে দেওয়া——-
সম্পূর্ণ বইটি পড়তে চাইলে নিচের ডাউনলোড বাটনে ক্লিক করে বইটি ডাউনলোড করে নিন।