একটু চোখ বুলিয়ে নিন
ফিলিস্তীনে আসব আমি
খৃস্টানদের চোখে ধূলি দিয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী দুর্গ অবরোধ করে ফেললেন। খৃস্টানরা যখন টের পেল, ততক্ষণে সুলতান আইউবী কার্ক অবরোধ করে ফেলেছেন। কিন্তু সেই অবরোধ ছিল অসম্পূর্ণ- ত্রিমুখী। গুপ্তচররা সুলতান আইউবীকে নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, তিনি আগেভাগেই কার্ক শহরে যে কমান্ডোদের পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে স্থানীয় মুসলিম বাসিন্দারা ভেতর থেকে দুর্গের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলবে। কিন্তু অবরোধের চতুর্থ দিন ভেতর থেকে এসে দূত সুলতানকে সংবাদ দিল যে, আপনার প্রেরিত কমান্ডো বাহিনী এবং কয়েকজন স্থানীয় মুসলিম নাগরিক কার্কের প্রাচীর ভাঙ্গতে গিয়ে শহীদ হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন মুসলিম মেয়েও রয়েছে। আছে একটি খৃস্টান মেয়েও। সুলতান আইউবী এ তথ্যও পেলেন যে, কে একজন ঈমান-বিক্রেতা নামধারী মুসলমান আপনবেশে কমান্ডোদের দলে ভিড়ে তথ্য নিয়ে খৃস্টানদের কাছে ফাঁস করে দেয়। ফলে খৃস্টানরা অভিযানের প্রাক্কালে ওঁৎ পেতে দলের সব কজন সদস্যকে হত্যা করে ফেলে। সুলতান আইউবীকে এ সংবাদও প্রদান করা হয় যে, এখন ভেতর থেকে প্রাচীর ভাঙ্গার আর কোন আশা নেই।
খৃস্টানরা দেখতে পেল, প্রাচীর ভাঙ্গার অভিযানে নিহতরা কার্কের-ই মুসলিম যুবক-যুবতী। সেই সূত্র ধরে তারা গণহারে মুসলমানদের ধর-পাকড় শুরু করে দেয়। মুসলিম মহিলারাও তাদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পায়নি। যুবকদেরকে ধরে ধরে বেগার ক্যাম্পে নিক্ষেপ করে। বৃদ্ধদেরকে নিজ নিজ ঘরে এবং যুবতী মেয়েদেরকে দুর্গের সামরিক ব্যারাকে বন্দী করে রাখে। খৃস্টানদের হাতে বন্দী হয়ে কতিপয় মেয়ে আত্মহত্যাও করে ফেলে। কারণ, কাফেররা তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করবে, তা তাদের জানা ছিল। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীও ধারণা করলেন যে, এর জন্য কার্কের মুসলমানদের চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হবে। জানবাজদের সংবাদ শুনে তিনি তার নায়েবদের উদ্দেশে বললেন
এটা একজন ঈমান-বিক্রেতার গাদ্দারীর ফল। একজন মাত্র গাদ্দার ইসলামের এত বিশাল একটি বাহিনীকে ব্যর্থ করে দিল। কেউ আল্লাহর নামেনিজের জান কোরবান করছে, আবার কেউ নিজের অমূল্য ঈমানটা কাফেরদের পায়ে উৎসর্গ করছে। গাদ্দাররা ইসলামের ইতিহাসের ধারাই পাল্টে দিচ্ছে…!
বলতে বলতে সুলতান ক্ষুব্ধ হয়ে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ান এবং প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে বললেন, অতি শীঘ্রই আমি কার্ক জয় করব এবং ঐ গাদ্দারদের উপযুক্ত শাস্তি দেব।
সুলতান আইউবীর ইন্টেলিজেন্স বিভাগের অফিসার জাহেদান কক্ষে প্রবেশ করেন। সুলতান তখন বলছিলেন
আজ রাতেই অবরোধ সম্পূর্ণ হওয়া চাই। কার্কের পেছন দিকে কোন্ বাহিনীকে পাঠাবে, একটু পরেই আমি তা জানাব।
ব্যাঘাত সৃষ্টি করার জন্য ক্ষমা চাই মহামান্য আমীরে মেসের- জাহেদান বললেন- বোধ হয় এখন আর আপনি অবরোধ পরিপূর্ণ করতে পারবেন না। আমরা সময় নষ্ট করে ফেলেছি।
তুমি কি নতুন কোন সংবাদ নিয়ে এসেছ? সুলতান আইউবী জিজ্ঞেস করেন।
দুশমনকে অসচেতন রেখে যেরূপ সফলতার সাথে অগ্রসর হয়েছিলেন, তার পূর্ণ সাফল্য আপনি উঠাতে পারলেন না- জাহেদান জবাব দেন।
তিনি এমন অবলীলায় কথা বলছিলেন, যেন নিম্নপদস্থ অধীন কাউকে দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন। এমনটা হবেই-বা না কেন। সুলতান তার সব সিনিয়র-জুনিয়র কমান্ডার ও প্রশাসনের সব বিভাগের কর্মকর্তাদের স্পষ্ট বলে রেখেছেন যে, তারা যেন তাকে রাজা ভেবে মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম না করে। সাহসিকতা ও পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে পরামর্শ দেয় এবং খোলাখুলি সমালোচনা করে। জাহেদান সুলতানের সেই নির্দেশনার উপরই আমল করছিলেন। তাছাড়া তিনি গোয়েন্দা বিভাগের প্রধানও বটে। তিনি এমন একটি চোখ, যে চোখ অন্ধকারেও দেখে। তিনি এমন একটি কান, যে কান শত শত মাইল দূরের ফিসফিস কানাঘুষাও শুনতে পায়। তিনি কত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তা সম্পূর্ণ অবগত। সুলতান জানেন, সফল গুপ্তচরবৃত্তি ছাড়া যুদ্ধে জয়লাভ করা যায় না। বিশেষত খৃস্টানরা যেখানে সালতানাতে ইসলামিয়ায় গুপ্তচর ও নাশকতাকারীদের জাল বিছিয়ে রেখেছে, সেখানে সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর অতিশয় উন্নত, অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ একটি গোয়েন্দা বাহিনীর একান্ত প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ সফল। তার গোয়েন্দা বিভাগের তিনজন অফিসার আলী বিন সুফিয়ান, তাঁর দুনায়েব হাসান ইবনে আবদুল্লাহ ও জাহেদান হলেন জানবাজ গুপ্তচর। বিচক্ষণতার সাথে তারা খৃস্টানদের বহু পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিয়েছেন।
আপনার তো জানা ছিল যে, খৃস্টানরা কার্কের প্রতিরক্ষা শক্ত করার পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক সৈন্য কার্ক থেকে খানিক দূরে প্রস্তুত করে রেখেছে জাহেদান বললেন- আপনাকে এ তথ্যও দেয়া হয়েছিল, এই বাহিনীটিকে বাইরে থেকে অবরোধ ভাঙ্গার কাজে ব্যবহার করা হবে। আমার গুপ্তচরদের তথ্যাদি দ্বারা বুঝা যাচ্ছে, খৃস্টানরা দুর্গের বাইরে লড়াই করবে। তারপরও আপনি সঙ্গে সঙ্গে অবরোধ পরিপূর্ণ করেননি। তা থেকে দুমশন উপকৃত হয়েছে।
তা তারা কি আক্রমণ করে ফেলেছে? বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী।