Porineeta By Sarat Chandra Chattopadhyay

পরিণীতা – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (Porineeta By Sarat Chandra Chattopadhyay)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

প্রথম পরিচ্ছেদ

শক্তিশেল বুকে পড়িবার সময় লক্ষণের মুখের ভাব নিশ্চয় খুব খারাপ হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু গুরুচরণের চেহারাটা বোধ করি তার চেয়েও মন্দ দেখাইল-_-যখন
প্রত্যুষেই অন্তঃপুর হইতে সংবাদ পৌছিল, গৃহিণী এইমাত্র নির্বিঘ্নে পঞ্চম কন্যার জন্মদান করিয়াছেন ।

গুরুচরণ ঘাট টাকা বেতনের ব্যাঙ্কের কেরানী । সুতরাং দেহটিও যেমন ঠিকাগাড়ির ঘোড়ার মত শুষ্ক শীর্ণ, চোখেমুখেও তেমনি তাহাদেরি মত একটা নিষ্কাম
নির্বিকার নির্লিপ্ত ভাব। তথাপি এই ভয়ঙ্কর শুভ-সংবাদে আজ তাহার হাতের হুকাটা হাতেই রহিল, তিনি জীর্ণ পৈতৃক তাকিয়াটা ঠেস দিয়া বসিলেন। একটা
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিবারও আর তাহার জোর রহিল না।

শুভ-সংবাদ বহিয়া আনিয়াছিল তাহার তৃতীয় কন্যা দশমবরাঁয়া আন্নাকালী | সে বলিল, বাবা, চল না দেখবে ।

গুরুচরণ মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন, মা, এক গেলাস জল আন ত খাই।

মেয়ে জল আনিতে গেল । সে চলিয়া গেলে, গুরুচরণের সর্বাগ্রে মনে পড়িল সৃতিকাগৃহের রকমারি খরচের কথা । তার পরে, ভিড়ের দিনে স্টেশনে গাড়ি
আসিলে দোর খোলা পাইলে থার্ড ক্লাসের যাত্রীরা পৌটলা-পৌটলি লইয়া পাগলের মত যেভাবে লোকজনকে দলিত পিষ্ট করিয়া ঝাঁপাইয়া আসিতে থাকে,
তেমনি মার-মার শব্দ করিয়া তাহার মগজের মধ্যে দুশ্চিন্তারাশি হুহু করিয়া ঢুকিতে লাগিল । মনে পড়িল, গত বৎসর তাহার দ্বিতীয়া কন্যার শুভ-বিবাহে
বৌবাজারের এই দ্বিতল ভদ্রাসনটুকু বাধা পড়িয়াছে এবং তাহারও ছয় মাসের সুদ বাকী । দুর্গাপূজার আর মাসখানেক মাত্র বিলম্ব আছে-_মেজমেয়ের ওখানে
তত্ব পাঠাইতে হইবে । অফিসে কাল রাত্রি আটটা পর্যন্ত ডেবিট ক্রেডিট মিলে নাই, আজ বেলা বারোটার মধ্যে বিলাতে হিসাব পাঠাইতে হইবে । কাল
বড়সাহেব হুকুম জারি করিয়াছেন, ময়লা বন্ত্র পরিয়া কেহ অফিসে ঢুকিতে পারিবে না, ফাইন হইবে, অথচ গত সপ্তাহ হইতে রজকের সন্ধান মিলিতেছে না,
সংসারের অর্ধেক কাপড়-চোপড় লইয়া সে বোধ করি নিরুদ্দেশ। গুরুচরণ আর ঠেস দিয়া থাকিতেও পারিলেন না, হু্কাটা উঁচু করিয়া ধরিয়া এলাইয়া
পড়িলেন। মনে মনে বলিলেন, ভগবান, এই কলিকাতা শহরে প্রতিদিন কত লোক গাড়ি-ঘোড়া চাপা পড়িয়া অপঘাতে মরে, তারা কি আমার চেয়েও তোমার
পায়ে বেশী অপরাধী! দয়াময়! তোমার দয়ায় একটা ভারী মোটরগাড়ি যদি বুকের উপর দিয়া চলিয়া যায়!

আন্নাকালী জল আনিয়া বলিল, বাবা ওঠ, জল এনেছি।

গুরুচরণ উঠিয়া সমস্তটুকু এক নিশ্বাসে পান করিয়া ফেলিয়া বলিলেন, আঃ, যা মা, গেলাসটা নিয়ে যা।

সে চলিয়া গেলে গুরুচরণ আবার শুইয়া পড়িলেন।

ললিতা ঘরে ঢুকিয়া বলিল, মামা, চা এনেচি ওঠ।

চায়ের নামে গুরুচরণ আর একবার উঠিয়া বসিলেন। ললিতার মুখের পানে চাহিয়া তাহার অর্ধেক জ্বালা যেন নিবিয়া গেল, বলিলেন, সারারাত জেগে আছিস

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top