Rokto Sagor Periye by Abul Asad-6

রক্ত সাগর পেরিয়ে – আবুল আসাদ (Rokto Sagor Periye by Abul Asad)

একটু চোখ বুলিয়ে নিন

সেদিন প্রতিদিনের মতই পিয়ালং উপত্যকার জীবন শুরু হলো। উপত্যকার ও পাহাড়ের গা বেয়ে কয়েক’শ তাঁবু।
উপত্যকার বড় তাঁবু থেকে আজানের ধ্বনি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার সংগে সংগে তাঁবুগুলো জেগে উঠল। পুরুষরা ওজু করে মসজিদে গেল। মেয়েরা আবার তাবুর ভেতরেই ফিরে গেল।
বাচ্চারা তখনও ঘুমে। মেয়েরা নামাজ সেরে কেউ গড়িয়ে নিচ্ছিল, কেউ বা তাবুর বাইরে এসে পাথরে বসে গুনগুন করছিল। হয় কুরআন তেলাওয়াত। নয়তো কোন উজবেক কবিতা তাদের মুখে। আবার কেউ ঘরকন্নার কাজ শুরু করে দিয়েছিল।
আর ছেলেরা নামাজ শেষে নিত্যকার মত মসজিদেই বসেছিল। ইমাম তকিউদ্দিন আলোচনা করছিলেন সমসাময়িক প্রসংগ নিয়ে। আলোচনা তার খুবই উপভোগ্য হয়, যতক্ষণ আলোচনা হয় বিছানার সাথে আঠার মত লেগে থাকে মানুষ। আজও তাই হয়েছে। নীরবে গোগ্রাসে গিলছে লোকেরা তার বক্তৃতা।
এমন সময় আকাশ থেকে হেলিকপ্টারের শব্দ ভেসে এল।
পিয়ালং আশ্রয় শিবিরের পরিচালক আবু ওমায়েরভ উঠে দাঁড়িয়ে ইমাম তকিউদ্দিনের কানে কানে কিছু বলল।
ইমাম সাহেব তার বক্তৃতা বন্ধ করে বলল, হেলিকপ্টারের শব্দ শুনা যাচ্ছে আপনারা শান্ত হয়ে বসুন। এখনই এ ব্যাপারে খবর পাবেন। ইমাম সাহেবের কানে কানে কথা বলার পরই আবু ওমায়েরভ মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। তার হাতে দূরবীন।
আকাশে তিনটি হেলিকপ্টার উপত্যকার প্রান্ত দিয়ে চক্কর দিচ্ছিল। চোখে দুরবীন লাগিয়ে ওমায়েরভ দেখল হেলিকপ্টারগুলোর গায়ে ‘ফ্র’- এর চিহ্ন আঁকা।
ওমায়েরভ দ্রুত ফিরে এল মসজিদে। সে আসার পর ইমাম তকিউদ্দিন তার কথা বন্ধ করল। কথা শুরু করল এবার ওমায়েরভ।
ওমায়েরভ পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক। তাসখন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ছাত্র সে। চাকুরী করছিল কৃষি দপ্তরের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশনে। বিয়ে করেছে দু’বছর হলো। সাইমুমের কর্মী ছিল ওমায়ের ছাত্র জীবন থেকেই। তার উপরের অফিসার ছিল অ-তুর্কি, রুশীয় অঞ্চলের একজন গোড়া অফিসার। তার চোখে ধরা পড়ে যায় ওমায়েরভ। অবশেষে সে গ্রেফতার এড়িয়ে রাতের অন্ধকারে সবকিছু ফেলে স্ত্রী এবং একমাত্র মেয়েটির হাত ধরে পালিয়ে আসে। সে এক বছর আগের কথা। বিশ্বস্ততা কর্মদক্ষতা গুনে সে এখন সাইমুমের একটি গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রের পরিচালক। বুদ্ধিমান ওমায়েরভ ‘ফ্র’ এর হেলিকপ্টার দেখেই বুঝতে পেরেছে, এ আশ্রয় কেন্দ্রের জন্য একটা চুড়ান্ত সময় আসন্ন। সে শান্ত কন্ঠে বলল, প্রিয় ভাইয়েরা শত্রুপক্ষের তিনটি হেলিকপ্টার আমাদের মাথার উপর উড়ছে। জানিনা তারা কি চায়। কিন্তু, যতটুকু আঁচ করা যায় তাতে বলতে পারি বোমার ভয় ওগুলো থেকে নেই, আর ওগুলো প্যারাট্রুপারস নামালে কয়জনকেই বা নামাতে পারে। সে সাহস তারা করবে বলে আমি মনে করি না। একটাই হতে পারে ওরা আরও নিচে নেমে এসে মেশিনগান দাগাতে পারে। এ অবস্থায় সকলের প্রতি আমার পরামর্শ আপনারা যে যার তাবুতে ফিরে যান, নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে তৈরী থাকুন এবং আদেশের অপেক্ষা করুন। হেলিকপ্টারগুলো থেকে যদি ফায়ার আসে তাহলে তা থেকে আত্মরক্ষা আপনাদেরই করতে হবে।
একটু থামল ওমায়েরভ। তারপর বলল, আপনারা আদেশ পাওয়ার সাথে সাথে স্থান ত্যাগের জন্যেও তৈরী থাকবেন। আমার মনে হয় এই হেলিকপ্টারগুলো একটা অনুসন্ধানী দল। এদের পাঠানো খবরের পরেই আমাদের উপর আসল বিপদ আসবে।
আবার থামল ওমায়েরভ। তারপর অত্যন্ত ধীর কন্ঠে বলল, প্রিয় ভাইয়েরা, আমরা আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি অনুসারে সাধ্যমত চেষ্টা করব, কিন্তু যে কোন পরিণতির জন্যই আমরা প্রস্তুত। জীবন এবং মৃত্যু দুই-ই আমাদের কাছে প্রিয়। আমাদের বাঁচাটা আল্লাহর জন্য, মৃত্যুও আল্লাহর জন্য। সুতরাং, কোন কিছুতেই আমাদের দুঃখ নেই, ভয় নেই। আমাদের শুধু প্রার্থনা যুগ যুগ ধরে এই ভুখন্ডের মুসলমানরা পরাধীনতার অসহনীয় জ্বালা ভোগ করছে, আল্লাহ্ তাদের মুক্ত করুন, স্বাধীনভাবে মুক্ত বায়ুতে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ তাদের দান করুন।
কথা শেষ করল ওমায়েরভ। নীরবে এক এক করে সবাই চলে গেল যে যার তাবুতে। ইমাম তকিউদ্দিনও।
সবার শেষে বেরুল ওমায়েরভ। অনেকখানি ফর্সা হয়ে গেছে তখন। হেলিকপ্টার আরো কিছুটা নিচে নেমে এসেছে। এক সাথেই তিনটা চক্কর দিচ্ছে। হেলিকপ্টারগুলো আকারে কিছুটা বড়, গঠনটাও একটু ভিন্ন প্রকৃতির। নিছক পর্যবেক্ষনের ছোট হেলিকপ্টার এগুলো নয়।
ওমায়েরভ তার তাবুতে এসে পৌছল। তার স্ত্রী আরেফা দু’বছরের মেয়েটির হাত ধরে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল। তার চোখে একরাশ শংকা। কিন্তু দু’বছরের ফাতিমা খুবই খুশী। ওমায়েরভ যেতেই মায়ের কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে এসে ওমায়েরভের হাত ধরে বলল, ঐ দেখ আব্বা, কি নাম ওটার?
ওমায়েরভ ওকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে বলল, ওটা হেলিকপ্টার।
এটুকু কথায় ফাতিমার মন তৃপ্ত হয়নি। হৈ চৈ করে আরও কিছু বলছিল সে। কিন্তু ওমায়েরভ সেদিকে কান দিতে পারলো না।
স্ত্রীর শংকাকুল চোখের দিকে চেয়ে ওমায়েরভ বলল, ওটা ‘ফ্র’ এর হেলিকপ্টার। আমাদের আশ্রয় কেন্দ্র ধরা পড়ে গেছে আরেফা। সম্ভবত আমাদের সরতে হবে। তৈরী হয়ে নাও।
বলে ওমায়েরভ তাবুর ভিতরে ঢুকে স্টেনগানটা কাধে তুলে নিল তার সাথে গুলির বাক্সও। তারপর বাইরে বেরুল সে তাবু থেকে। আবার দৃষ্টি ফেললো হেলিকপ্টারের দিকে। এবারের বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করল, হেলিকপ্টারগুলো গোটা উপত্যকা কভার করে তিনটি সমান্তরাল লাইনে এগিয়ে আসছে কাত হয়ে, ঠিক বোমারু বিমানগুলোর বোমা ফেলার ভংগির মত করে। তাহলে কি কিছু ফেলছে হেলিকপ্টারগুলো? কি ফেলছে? উৎকন্ঠিত হয়ে উঠল ওমায়েরভ।
হেলিকপ্টারগুলো আসছে উত্তরদিক থেকে বাতাসও উত্তরে হঠাৎ বাতাসে সুক্ষ্ণ এক অপরিচিত গন্ধ পেল সে। বিজ্ঞানের ছাত্র ওমায়েরভ সংগে সংগে বুঝতে পারল, অন্য কিছু নয় গ্যাসের গন্ধ এটা। ওরা তাহলে গ্যাস বোমা ফেলছে?
আৎকে উঠল ওমায়েরভ। দৌড়ে সে তাবুর ভিতরে ঢুকে গেল এবং ব্যাটারী চালিত সাইরেন বের করে এনে চেপে ধরল তার সুইচ।
তীব্র কন্ঠে বেজে চলল সাইরেন।
হৈ চৈ পড়ে গেল আশে পাশের তাবুগুলোতে। এ সংকেতের অর্থ সকলেই বুঝে। এ সংকেতের নির্দেশ ছুটে সরে যেতে হবে অন্য কোথাও।
হেলিকপ্টারগুলো অর্ধেকটা উপত্যকা পেরিয়ে এসেছে। ছুটে আসছে ওগুলো। বাতাসে গন্ধ বেড়ে গেছে, কেমন যেন ভারী মনে হচ্ছে বাতাস। স্ত্রী আরেফা বলল, ফাতিমা কেমন যেন করছে।
চমকে ফিরে তাকাল ওমায়েরভ। দেখল, ফাতিমার ঘাড় কাত হয়ে ঢলে পড়েছে। তার হাতে পায়ে হাত দিয়ে বুঝল ওগুলো ঠান্ডা এবং শিথিল। হৃদয়ে যন্ত্রণার এক ছোবল লাগল ওমায়েরভের। ভাবল সে, তাদেরও তো এখান থেকে সরে পড়া দরকার। কিন্তু কেমন করে পালাবে সে সবাইকে রেখে।
স্ত্রীর দিকে চেয়ে ওমায়েরভ বলল, আরেফা, শত্রুরা গ্যাসবোমা ছেড়েছে। তুমি ফাতেমাকে নিয়ে পালাও। আমি আসছি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top