একটু চোখ বুলিয়ে নিন
এক
১৮৬৬ সাল। শুধু সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোই নয়, গোটা দুনিয়ার অগণিত
মানুষ- বিশেষ করে নাবিকেরা, চমকে উঠেছিল খবরটা শুনে
নাকি জাহাজের লোকেরা অদ্ভুত এক অতিকায় প্রাণীর দেখা পাচ্ছে গভীর
সমুদ্রে। তিমির চেয়ে অনেক বড় আর অস্বাভাবিক দ্রুত গতিসম্পন্ন ওই প্রাণীটার
গড়ন লম্বাটে, মুখটা ছুঁচাল। রাতের বেলা এর পিঠের উপর জ্বলে ওঠে ফসফরাসের
মত উজ্জ্বল আলো। কেউ বলে দৈর্ঘ্যে এটা দুশো ফুট আবার কারও মতে মাইল
তিনেক, প্রস্থে এক থেকে দেড় মাইল ।
এই বছরেরই ২০ জুলাই ক্যালকাটা অ্যা্ড বার্ণাক স্টাম নেভিগেশন কোম্পানির
‘গভর্নর হিগিনসন’ নামে একটা জাহাজ অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব-উপকূল থেকে পাচ মাইল
দূরে দেখল ওই আজব সচল বন্তুটাকে। স্থির হয়ে পড়ে থাকতে দেখে জাহাজের
ক্যাপ্টেন বেকার প্রথমে এটাকে বালিয়াড়ি ভাবলেন । কিন্তু একটু পরই পিঠ থেকে
প্রচণ্ড শব্দে দুটো পানির ধারা শূন্যে নিক্ষিপ্ত করে ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল ওটা
গভীর পানিতে ।
তিনদিন পর প্রশান্ত মহাসাগরে ঠিক একই দৃশ্য দেখল “কলম্বাস’ নামে ওয়েস্ট
ইগ্ডিয়া আযা্ড প্যাসিফিক স্টাম নেভিগেশন কোম্পানির আর একটা জাহাজ ।
ক্যাপ্টেন বেকারের দেখা জায়গা থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের এ এলাকার দূর
২৪৫০ নটেরও (সামুদ্রিক মাইল) বেশি। এ থেকেই আন্দাজ করা যায় কত দ্রুত
চলতে পারে প্রাণীটা ।
পনেরো দিন পর, “হেলভেশিয়া’ ও ‘শ্যানন’ নামে দুটো জাহাজ আরও
দু’হাজার মাইল দূরে আটলান্টিকে দেখল এটাকে । দুটো জাহাজের ক্যাপ্টেনই
অনুমান করলেন লম্বায় সাড়ে তিনশো ফুটের মত হবে প্রাণীটা। অথচ পৃথিবীর
সবচে বড় প্রাণী নীল তিমির দৈর্ঘ্যও সাধারণত নব্বই ফুটের বেশি হয় না।
তারপর প্রায় দু’বছর আর পাত্তা নেই। ঘটনাগুলো সবাই ভুলতে বসেছে ঠিক
এমনি সময়, ১৮৬৮ সালের গোড়ার দিকে আবার দেখা দিল দানবটা | তবে
এবারে আর দেখা দিয়েই ক্ষান্ত হলো না। জাহাজগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে
বসল সে। ৫ মার্চ রাতে ‘মোরাভিয়ান’ নামে একটা জাহাজ (২৭০ ৩ অক্ষাংশ ও
৭২:১৫ দ্রাঘিমাংশ) হঠাৎ শিলাখণ্ডে আটকে যেতে যেতে বেঁচে গেল। অথচ ওই
এলাকার চার্ট খুঁজে শিলাখণ্ডের নামগন্ধও পাওয়া গেল না। অনুকূল বাতাস চারশো
হর্স পাওয়ার ইঞ্জিনের মিলিত শক্তিতে তেরো মাইল বেগে চলস্ত ‘মোরাভিয়ানে”র
তলাটা অত্যন্ত মজবুত না হলে ২৩৭ জন যাত্রী নিয়ে ওই’সংঘর্ষেই ডুবে যেত।
দুর্ঘটনার সাথেশসাথে জাহাজের উ্পদহ্ কর্মচারীরা ডেকে দু এলেন।
জাহাজ থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে সাগরের পানিতে একটা প্রচণ্ড ঘূর্ণি ছাড়া আর
কিছুই দেখলেন না তারা । কিসের সঙ্গে ধাক্কা খেল জাহাজ বুঝতে পারলেন না
কেউ । পরে মেরামতের সময় দেখা গেল জাহাজের তলার দিকে একটা অংশ ভেঙে
গেছে।
লেখক সম্পর্কে
জুলভার্ন ও তার সৃষ্টি
ফরাসী দেশের অন্ধ এক দ্বীপ নানতেস। সে দ্বীপে ১৮০০ খিস্টাব্দের ৮
ফেব্রুয়ারি জন্ম জুলভার্নের | প্রাথমিক পাঠ নানতেসের প্রাইমারিতে । তারপর
‘ সর্বোচ্চ ডিথ্রী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । আইন পাশ করে হন আইনবিদ।
যোগ্যতা এবং ব্যবহারগুণে অল্পদিনেই আইন ব্যবসায় বিপুল খ্যাতি অর্জন .
করেন, সেইসাথে অর্থও আয় করতে থাকেন।
কিন্তু জুলভার্ন তো অন্য দশ জন মানুষের মতো নন । বাধাধরা জীবন, অর্থের
জন্য সত্যমিথ্যা নানা কৌশল ও অনর্থক কথা ব্যয় তার ধাতে সয় না। এ যেন
নিজের সঙ্গে নিজের ধৃষ্টতা । .
জুলভার্নের মন বিজ্ঞানীসুলভ। নতুন নতুন চিন্তায় তিনি ডুবে থাকেন।
দুঃসাহসী সমুদ্র অভিযান সম্পর্কে জানার প্রবল আগ্রহ। বিজ্ঞান বিষয়ক বই আর
“বিজ্ঞান-আবিষ্কার সম্পর্কে অনেককিছু জানতে চান জুলভার্ন।
এই নিরলস সাধনা এবং প্রত্যয় তাকে বিজ্ঞানের কাল্লিক জগতে নিয়ে যায় ।
অসম্ভব সব কল্পনার পাখায় ভর করে তিনি উড়ে চলেন বিজ্ঞানের বাস্তব
আকাশে ।
জাদুমাখা তার কলম । কলমের নিব থেকে যা বেরোয় তাই হয়ে ওঠে
সত্যের চেয়েও সত্য । কল্পনাতীত কল্পনার আশ্চর্য বাস্তব । আসলে. তার সঙ্গে
করাও কঠিন । সাফ কথায় বলবো-জুলভার্ন, জুলভার্নই। কল্পবিজ্ঞান কাহিনী বা
সায়েন্স ফিকশনের তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্ি লেখক । ঠিক, আর্থার কোনান ডয়েলের
মতো । ডয়েল যেমন, গোয়েন্দা কাহিনীর একক সম্রাট । না, জুলভার্ন বিজ্ঞানী
নন। কিন্তু, তিনি বিজ্ঞানীদের পথিকৃৎ-একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। শত
বছরের আগের জুলভার্নের কল্পনায় যে বিজ্ঞান, কল্পনার কলমে
এসেছে-পরবতীতে বাস্তব পৃথিবীতে সেই বিজ্ঞান আবিষারটি সত্যে প্রমাণিত
‘হয়েছে।
আজকের অনেক আবিষ্কার-জুলভার্নের কলমে অতীতে বর্ণিত হয়েছে । না, .
তিনি জাহাজে চড়ে শুধু সাত সাগর চষে বেড়ান নি। বিমানে চড়ে পৃথিবীর
আয়তন মাপেন নি। বন-উপবন-অরণ্য-উপত্যাকায় ছুটে বেড়ান নি জগতের
অজানা তথ্য উত্ঘাটনে | তিনি যা করেছেন, যা লিখেছেন নিরিবিলি, নির্জনে
নিজের ছোট্ট ঘরটিতে বসে। তিনি কল্পনার রথে চড়ে বেড়িয়েছেন । বাস্তবে
নয়। অথচ কী অচিন্তনীয় শক্তি ছিল তার।
তার “মিষ্টরিয়াস আইল্যান্ড’-অসাধারণ এই কল্পবিজ্ঞান গ্রন্থটি পাঠকের মন
আকৃষ্ট করে। এ কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র হয়েছে । সেই চলঙচ্চিত্র-সারাবিশ্বের
টিভি দর্শকরা দেখে তন্ময় হয়েছেন, ঠিক বাস্তবেই যেন ঘটছে এমন মনে
হয়েছে দর্শকদের ।
টুয়েন্টি থাউজেন্ লীগস আন্ডার দ্য সী। নোটিলাস, ব্লাক ডায়মন্ড, এরাউন্ড
দ্য ওয়ার্লড ইন এইটটি ডেজ, জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ, ফাইভ ইউ*কস
ইন এ বেলুন দ্য ক্রিসেন্ট অব দ্য আইল্যান্ড ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন, রাউন্ড দ্য
মুন, দ্য সিক্রেট অব দ্য আইল্যান্ড, দ্য স্টিম হাউস, এ ফ্লোটিং সিটি,
আ্যাডভেঞ্চার্স অব ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস দ্য মাস্টার অব দ্য ওয়ার্লড, দ্য বেগমস
” ফরচুন, এক্সপেরিমেন্ট অব ডক্টর অক্সু, দ্য পারচেজ অব দ্য নর্থ পোল- ইত্যাদি
জুলভার্নের শ্রেষ্ঠ কীর্তি ।
ূ আশ্চর্য হতে হয় যখন দেখি, জুলভার্ন বিজ্ঞানী না হয়েও অসাধারণ বিজ্ঞানী,
অভিযাত্রী না হয়েও দুঃসাহসী অভিযাত্রী, গণিতবিদ না হয়েও নির্ভুল গণিত
বিশ্লেষক, ভূগোলবিদ না হয়েও ভূগোল সম্পর্কে অসাধারণ জ্ঞান এবং
মহাকাশচারী না হয়েও মহাকাশ সম্পর্কে অসাধারণ বিজ্ঞান ভিত্তিক তথ্যের
পল্ভিত ।
আসলে জুলভার্ন সবকিছুই তার কল্পনার কলমে বলেছেন । সে কল্পনা-
জীবনের সত্যগল্প হয়েছে, হয়েছে বিশ্বাস্য উপন্যাস ।
শুধু কি ছোটরা! চুলপাকা, দাতপড়া বুড়ো দাদুটিও যখন তার মিশ্টিরিয়াস
ডকুমেন্ট, ক্লীপার অব দ্য কাউডস প্রপেলার আইল্যান্ড অথবা মাস্টার
জ্যাকারিউস, দ্য স্কুল ফর রবিনসন্স, ফর দ্য ফ্যাগ, দ্য স্কীন ফ্ল্যাস, সিটি ইন দা
সাহারা-যেটাই পড়েন না কেন একেবারে অবাক হয়ে যাবেন । হারিয়ে যাবেন
এক নতুন সত্য পৃথিবীতে ।
প্রায় অর্ধশত কাহিনীর জনক জুলভার্ন ৷ তার বাবার স্বপ্র-‘ ছেলে হবে নাম করা
ধনাঢ্য আইন ব্যবসায়ী”; এই স্বপ্ন রাখতে পারেন নি ঠিকই, কিন্তু সেই স্বপ্নের
চেয়েও বড় স্বপ্নকে তিনি জয় করেছেন। বাবার ইচ্ছেকে তিনি একেবারে পূরণ
করেন নি এটা নয়, ঠিকই তিনি আইনবিদ হয়েছিলেন, কিন্তু সে জগত ছেড়ে
তিনি আরো বড় জগতের রাজা হয়েছিলেন । সে জগতের নাম-কষ্াবিজ্ঞানের
অসীম-অশেষ মহাজগত ||
ফ্রাঞ্চের জুলভার্ন ৬৭ বছর বয়সে আমেরিকায় পাড়ি জমান । সেখানেই তার
সেরা সৃষ্টিগলি রচিত হয় ৷ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তার সমগ্র রচনা ।
হাতে পৌছে গেছে পৃথিবীর চারপাশে ।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ। যুক্তরাষ্ট্রের আযাসিয়েন্সয়ে এই আশ্চর্য মহাপ্রাণের
প্রাণ প্রদীপ নিভে যায়। নিভে নি তার সৃষ্টির আলোকরশ্যি। তা জুলছে এবং
জ্বলবে!
বাংলাভাষা আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি ভাষা । এই বাংলা ভাষাতেও জুলভার্ন আজ
প্রকাশিত। তীর সৃষ্টিকর্ম ইতোমধ্যে বাঙালি অনুবাদকদের হাতে অনুদিত
হয়েছে। কিন্তু, অনুবাদ ঠিক অবিকল জুলভার্নকে তুলে ধরতে পারেনি, সাহিত্য
প্রবন্ধ বাদে-মানে কোনো মৌলিক সাহিত্যের প্রকৃত অনুবাদ হয় না। তবুও,
কেউ কেউ চেষ্টা করেছেন-যতোটা সম্ভব অবিকল রাখা । বর্তমান সংকলনটি
কতটুকু সফল হয়েছে তা সচেতন পাঠকদের কাছে বিচার্য।