একটু চোখ বুলিয়ে নিন
১
আব্দুল গফুরের বাড়ি থেকে তারা মাত্র কয়েক’শ গজ এগিয়েছে। হেলিকপ্টারের কাছে পৌঁছতে এখনও অনেকটা পথ বাকী। হাসান তারিক আগে আগে চলছিল, পেছনে আব্দুল্লায়েভ। রাস্তার দু’ধারে আব্দুল্লায়েভদের গমের ক্ষেত। বলিষ্ঠ সবুজ গমের গাছগুলো দু’ফুটের মত লম্বা হয়ে উঠেছে। সামনে রাস্তার ডানপাশে একটা ঝোপ।
উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টিটা সামনে ছড়িয়ে পথ চলছিল হাসান তারিক। মনে মনে গুন গুন করে আল-কোরআনের একটা আয়াত পাঠ করছিলঃ ‘রাব্বানাগ ফিরলানা যুনুবানা ওয়া ইসরাফানা ফি আমরিনা ওয়া সাব্বিত আকদামানা ওয়ানসুরনা আলাল কাউমিল কাফিরীন।’
হঠাৎ হাসান তারিকের চোখে পড়ল কারো একটা মাথা যেন ঝোপের বাইরে এসেই আবার ঝোপের আড়ালে মিলিয়ে গেল। হাসান তারিকের সতর্ক স্নায়ুতন্ত্রী জুড়ে একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল। হঠাৎই মনটা তার তোলপাড় করে উঠল। চিন্তা দ্রুত হলো। কে লুকাল ওমন করে ঝোপের মধ্যে কেন লুকালো?
পেছন দিকে না ফিরেই হাসান তারিক জিজ্ঞেস করল, ‘আব্দুল্লায়েভ’ পাড়ায় তোমাদের কি কোন শত্রু আছে?’
‘না’-আবাদুল্লায়েভ জবাব দিল। তারপর উল্টো প্রশ্ন করল, ‘কেন এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন?’ আব্দুল্লায়েভের কন্ঠে বিস্ময়। হাসান তারিক কোন জবাব দিল না আব্দুল্লায়েভের প্রশ্নের। নানা চিন্তা তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন জাগল, জেনারেল বরিসরা কি চলে গেছে? বড় একটা শিকার তারা ধরেছে বটে, কিন্তু আর কি শিকার নেই? মধ্য এশিয়া মুসলিম সাধারণতন্ত্রের প্রধান কর্ণেল কুতায়বাও কি লোভনীয় শিকার নয়? এই কথা চিন্তা করার সাথে সাথে হাসান তারিকের মনটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। সেই সাথে পীড়া অনুভব করল মনে, এই সহজ সম্ভাবনার কথাটা কেন তাদের আগে মনে হয়নি।
তখনও ঝোপটা ১শ গজের মত দূরে। নিশ্চিত না হয়ে আর এগুনো ঠিক মনে করল না হাসান তারিক।
দাঁড়িয়ে পড়ল সে। বিস্মিত আব্দুল্রায়েভ পাশে এসে দাঁড়াল। হাসান তারিকের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কিছু ঘটেছে তারিক ভাই?’ তার কন্ঠে উদ্বেগ।
আব্দুল্রায়েভের প্রশ্নের প্রতি কোন মনোযোগ না দিয়ে হাসান তারিক জিজ্ঞেস করল, ‘কেউ বা কারা যেন এ ঝোপে লুকিয়ে আছে। তারা এ পাড়ার কেউ হতে পারে বলে কি তুমি মনে কর?’
একটু চিন্তা করল আব্দুল্লায়েভ। তারপর বলল, আমাকে দেখার পর কোন উদ্দেশ্যে কেউ এই ঝোপে লুকাবে এমন কেউ এই পাড়ায় নেই।’ একটু দম নিয়ে সে বলল, ‘এমন কিছু কি ঘটেছে তারিক ভাই?’
‘হ্যাঁ।’ সংক্ষিপ্ত জবাব দিল হাসান তারিক।
‘তাহলে আমি দেখি’ বলে সামনের দিকে পা বাড়াতে চাইল আব্দুল্লায়েভ। হাত বাড়িয়ে তাকে বাধা দিল হাসান তারিক। বলল, ‘কোন ব্যাপারকেই ছোট করে দেখা ঠিক নয় আব্দুল্লাহ, রিভলবারটা বের করে নাও। দেখ ওটা গুলি ভর্তি আছে কিনা।’ বলে হাসান তারিক নিজেও জ্যাকেটের পকেট থেকে নিজের রিভলভারটা বের করে নিল।
এই সময় পেছনে আব্দুল্লায়েভের বাড়ির দিক থেকে সাব মেশিনগানের একটানা ব্রাশফায়ারের আওয়াজ ভেসে এল।
চমকে উঠে পেছন ফিরল দু’জনেই। মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত। ঝোপের দিক থেকে গর্জে উঠল কয়েকটা সাবমেশিনগান।
বিদ্যুত বেগে দু’জনেই বসে পড়ল। বসে পড়েই এক হাতে রিভলভার অন্য হাতে আব্দুল্লায়েভের হাত ধরে টেনে নিয়ে দৌড় দিল হাসান তারিক রাস্তার ডান পাশে একটা গাছের আড়ালে।
সেই ঝোপ থেকে ওরা জনা পাঁচেক লোক গুলি করতে করতে ছুটে আসছিল রাস্তা দিয়ে। প্রায় ৫০ গজ দূরে ওরা এসে পড়েছে। ওদের চোখে সন্ধানী দৃষ্টি, কিছুটা বিমূঢ় ভাবও। দু’জন মানুষ হঠাৎ কোথায় গেল এটাই বোধ হয় চিন্তা। কিন্তু তাদেরকে খুব সতর্ক মনে হলো না। লক্ষ্যহীনভাবে গুলির দেয়াল সৃষ্টি করে সৈনিকরা যেমন আত্মরক্ষামূলকভাবে সামনে এগোয়, তাদের আচরণটা সে রকমই। তাদের লক্ষ্য রাস্তা বরাবর সামনের দিকে, পাশের দিকে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
আরো কাছে চলে এসেছে তারা। গাছের গুড়ির সাথে মিশে রিভলভার বাগিয়ে অপেক্ষা করছিল হাসান তারিক। গাছের বাম পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল ওদের গুলি। কিছু গুলি এসে গাছে বিদ্ধ হচ্ছিল। কচিৎ দু’একটা গাছের ডান পাশ দিয়ে আসছিল। ওরা যখন আরও কাছে এসে পড়ল; তখন ডান পাশ দিয়ে গুলি আসা বন্ধই হয়ে গেল। হাসান তারিক এবার তার রিভলভারের ট্রিগারে আঙ্গুল চেপে মাথাটা একটু বাড়াল।