একটু চোখ বুলিয়ে নিন
হাইকোর্টে দেবকুমারবাবুর মামলা শেষ হইয়া গিয়াছিল।
মাঘ মাসের মাঝামাঝি। শীতের প্রকোপ অল্পে অল্পে কমিতে আরম্ভ করিয়াছে।
মাঝে মাঝে দক্ষিনা বাতাস গায়ে লাগিয়া অদূর বসন্তের বার্তা জানাইয়া দিলেও, সকাল-
বেলায় সোনালী রোদ্রটুকু এখনও বেশ মিঠা লাগে।
সেদিন সকালে আমি একাকী জানালার ধারে বসিয়া রৌদ্র সেবন করিতে করিতে
সংবাদপত্রের পাতা উল্টাইতে ছিলাম। ব্যোমকেশ প্রাতরাশ শেষ করিয়াই কি একটা কাজে
বাহির হইয়া গিয়াছিল: বলিয়া গিয়াছিল, ফিরতে দশটা বাঁজিবে।
খবরের কাগজে দেবকুমারবাবু মোকম্দমার শেষ কিস্তির বিবরণ বাহির হইয়াছিল।
কাগজের বিবরণ পড়িবার আমার কোনও দরকার ছিল না, কারণ আমি ও ব্যোমকেশ
মোকদ্দমার সময় বরাবরই এজলাসে হাজির ছিলাম। তাই অলসভাবে কাগজের পাতা উল্টাইতে
উল্টাইতে ভাবিতোছিলাম_ দেবকৃমারবাবূর অসম্ভব ‘জিদের কথা। তিনি একট নরম
হইলে হয়তো এতবড় খুনের মোকম্দমা চাপা পড়িয়া যাইত; কারপ উচ্চ রাজনীতি পিনাল
কোডের শাসন মানিয়া চলে না। কিস্তু সেই যে তিনি জিদ ধরিয়া বসিলেন আবিষ্কারের
ফরমৃলা কাহাকেও বলিবেন না-সে-জিদ হইতে কেহ তাঁহাকে টলাইতে পারিল না। দেশলাই
কাঠি বিশ্লেষণ করিয়াও বিষের মূল উপাদান ধরা গেল না। অগত্যা আইনের নাটিকা
যথারীতি অভিনীত হইয়া এই শোচনীয় বাপারের শেষ অঙ্কে যবনিকা পড়িয়া গেল।
চিন্তা ও কাগজ পড়ার মধো মনটা আনাগোনা করিতেছিল, এমন সময় পাশের ঘরে
টোলফোন বাঁজয়া উঠিল। উঠিয়া গিয়া ফোন ধরিলাম। দারোগা বীরেনবাব্ থানা হইতে
ফোন করিতেছেন, তাঁহার কণ্ঠস্বরে একটা উত্তেজিত ব্যগ্রতার আভাস পাইলাম্।
‘ব্যোমকেশবাবু আছেন
এখনি বেরিয়েছেন। কোনও জরুরি দরকার কি?
হাঁ-তিনি কখন ফিরবেন ?
দশটার সময়?”
‘আচ্ছা. আমিও দশটার সময় গিয়ে পৌছব। একটা খারাপ খবর আছে :
খবরটা ‘কি জিজ্ঞাসা করিবার পূর্বেই বীরেনবাবু ফোন কাটিয়া দিলেন।
ফিরিয়া গিয়া বসিলাম। ঘড়িতে দেখলাম বেলা ন’টা। মন ছটফট করিতে লাগিল. তবুও
সংবাদপত্রটা তুলিয়া যথাসম্ভব ধীরভাবে দশটা বাজার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম।
কিন্তু দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হইল না, সাড়ে ন’টার পরই ব্যোকেশ ফিরল।
বীরেনবাবু ফোন করিয়াছেন শুনিয়া সচকিতভাবে বলল, “তাই নাকি! আবার কি হল?
আমি নীরবে মাথা নাঁড়লাম। ব্যোমকেশ তখন পুুটিরামকে ডাকিয়া চায়ের জল
চড়াইতে বলিল; কারণ, বীরেনবাবুকে অভ্যর্থনা করিতে হইলে চায়ের আয়োজন চাই :
চা সম্বন্ধে তাহার এমন একটা অকুণ্ঠ উদারতা আছে যে তুচ্ছ সময় অসময়ের চিন্তা উহাকে সংঙ্কুচিত করিতে পারে না।
চায়ের হুকুম দিয়া ব্যোমকেশ চেয়ারে হেলান দিয়া বসিয়া সিগারেট বাহির করল:
একটা সিগারেট ঠোঁটে ধরিয়ে পকেট হইতে দেশলাই বাহির করিতে করিতে বলিল,
“বীরেনবাবু যখন বলেছেন খারাপ খবর, তার মানে গুরুতর কোন কিছু। হয়তো-
ব্যোমকেশ হঠাৎ থামিয়া গেল।’ আমি মৃখ তুলিয়া দেখিলাম সে বিস্ময়-বিমৃ্ঢ়ভাবে
হস্তধৃত দেশলায়ের বাক্সটার ‘দিকে তাকাইয়া আছে।
লেখক সম্পর্কে
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক। তাঁর জন্ম উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর শহরে নিজ মাতুলালয়ে। আদিনিবাস পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যস্থিত উত্তর কোলকাতার বরানগর কুঠিঘাট অঞ্চল৷ তাঁর রচিত প্রথম সাহিত্য প্রকাশিত হয় তার ২০ বছর বয়সে, যখন তিনি কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজে আইন নিয়ে পড়াশুনো করছিলেন।