একটু চোখ বুলিয়ে নিন
বর্তমান গযনী শহর তিন দশক ধরে একের পর এক পরাশক্তির আগ্রাসনে পর্যুদস্ত। দখলদার রাশিয়ার কবল থেকে দীর্ঘদিন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্ত হয়ে মরার উপর খাড়ার ঘা এর মতো গৃহযুদ্ধের বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারো আমেরিকার আগ্রাসনের শিকার হয়েছে সুলতান মাহমূদের প্রিয় ভূমি গযনী। হয়েছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের পরীক্ষাগার। বিশ্বের সবচেয়ে বেশী ক্ষতিকর বোমাগুলোর বিস্ফোরণস্থল বানানো হয়েয়ে সুলতান মাহমূদের গযনীকে। ইসলাম বিদ্বেষী ইহুদী খ্রিস্টানদের হাইড্রোসেন বোমার গবেষণাগারে পরিণত হয়েছে অমিততেজী স্বাধীন ঈমানদীপ্ত সুলতানের জন্মভূমি। শুধু গযনী নয় গোটা আফগানিস্তানের প্রতি ইঞ্চি জমি আজ বহুজাতিক বাহিনীর নিক্ষিপ্ত বোমা ও গোলার আঘাতে বিষাক্ত।
হাজার বছরের স্থাপনা ও ইসলামী ঐতিহ্যের চিহ্নগুলো বছরের পর বছর ধরে চলে আসা যুদ্ধান্মদনায় ধ্বংসকূপের নিচে চাপা পড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। সেই সুলতান মাহমুদের দুর্বার অভিযান আর স্বজাতি ও ইসলামকে সুউচ্চে উচ্চকিত করার সেই সোনালি দিনগুলো আজকে শুধুই স্মৃতি। মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই পার্থিব স্বার্থে স্বজাতির চিহ্নিত দুশমনদের সাথে বিনাশী দোস্তিতে মত্ত। জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে কথিত দেশপ্রেমিকের বেশে বিদেশী বরকন্দাজ। তবে গযনীর মাটি এখনো সম্পূর্ণ ভুলে যায়নি হয়নি তার অতীত।
এখনো গযনীর মাটিতে একদল আল্লাহর সৈনিকের পদচারণা রয়েছে। সুলতানি না থাকলেও মাহমূদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই একদল অমিত সাহসী যোদ্ধা বিদেশী দখলদারদের বিতাড়িত করে গোটা আফগানিস্তানকে পুনর্বার
ইসলামী পতাকার ছায়াতলে আনার জন্যে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে। বিগত তিনদশক ধরেই গযনী ও সংশ্লিষ্ট এলাকার মায়েরা তাদের সন্তানদের পায়ে বেড়ি না বেঁধে আল্লাহর পথে জিহাদের জন্যে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে। আজো শত শত কন্যা জায়া জননী তাদের পিতা স্বামী সন্তান ভাইকে ইসলামের জন্যে উৎসর্গ করছে। বিলীন হয়ে যায়নি সুলতান মাহমুদের স্মৃতি, হারিয়ে যায়নি সুলতান মাহমূদের অভিযান। একদল মর্দেমুজাহিদ নিজেদের জীবন ও দেহের তাজা খুন ঢেলে দিয়ে নতুন করে রচনা করছে ত্যাগ ও জীবন দানের নতুন ইতিহাস। ঈমান ও ইসলামকে আল্লাহর জমিনে প্রতিষ্ঠিত করার নতুন অধ্যায়।
একজন মূর্তি সংহারীর জন্মভূমি হিসেবেই শুধু ইতিহাসে গযনী স্মরণীয় ছিল না। গযনী খ্যাতি পেয়েছিল সেখানকার অসাধারণ স্থাপত্য কীর্তি ও অসংখ্য শৈল্পিক ধাচে নির্মিত দালান কোঠা ও বড় বড় অট্টালিকার জন্যে।
সুলতান মাহমূদ কনৌজ বিজয়ের পর হিন্দুস্তান থেকে গযনী ফিরে এসে তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নির্মাণশিল্পীদের দিয়ে গযনীতে মর্মর পাথরের একটি ঐতিহাসিক মসজিদ নির্মাণ করিয়েছিলেন। সেই সাথে মসজিদ সংলগ্ন স্থানেই গড়ে তুলেছিলেন সর্বাধুনিক কারিকুলাম ও তথ্যসমৃদ্ধ একটি বিশ্ববিদ্যালয় । সেই সময়ের সব জ্ঞান-বিজ্ঞানই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্চিত হতো।
এ মসজিদ নির্মিত হয়েছিল মথুরা জয়ের স্মারক হিসেবে। হিন্দুস্তান অভিযানে যেসব মুজাহিদ শাহাদত বরণ করেছিল তাদের স্মৃতি হিসেবে তিনি সুউচ্চ মিনার নির্মাণ করেন। কারণ, মথুরা ভারতের হিন্দুদের কাছে এমনই পবিত্র যেমনটি মুসলমানের কাছে মক্কা মদীনা।
মথুরা হিন্দুদের দেবতা শ্রীকৃষ্ণের জন্মভূমি। মথুরার প্রধান মন্দিরের মূর্তিগুলোকেও পবিত্র বলে মনে করা হতো।
মসজিদ তৈরি করার জন্যে দেশ-বিদেশ থেকে নামী-দামী নির্মাণ শিল্পীদের আনা হলো। তারা সুলতান মাহমূদের কল্পনা ও ভাবনার চেয়েও বেশী সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করে ফেলল। সুলতান মাহমূদ মসজিদের দেয়াল গাত্রের বিভিন্ন কারুকার্যে সোনা-রুপা গলিয়ে কারুকার্যকে আরো দৃষ্টিনন্দন করে তুললেন। মসজিদের ভেতরে সুদৃশ্য গালিচা বিছানো হলো। মসজিদ সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ভাষার গ্রন্থরাজি সংগ্রহ করা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে একটি যাদুঘরও তৈরী করা হলো। সেখানে সংরক্ষণ করা হলো বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন।
সুলতান মাহমূদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্যে আলাদা তহবিল গড়ে তুললেন।
মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে সুলতানের আগ্রহ দেখে গযনীর বিত্তশালী ব্যক্তি ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তাদের রুচি ও আভিজাত্যের সমন্বয়ে বহু মসজিদ, নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর বাড়ি নির্মাণ করলেন। ফলে গযনী শহর আধুনিক স্থাপত্য শিল্প ও ইমারতে জাকজমকপূর্ণ হয়ে উঠলো। সুলতান মাহমুদ ও তার প্রিয় গযনীবাসীর এই উন্নতি এমনিতেই হয়নি। এ জন্যে তাকে একের পর এক অভিযান পরিচালনা করতে হয়েছে।
আধুনিক গযনী গড়ে ওঠার মূলে হাজারো গযনীবাসীর জীবন যৌনব বিসর্জন দিতে হয়েছে। গযনীর হাজার হাজার মর্দেমুজাহিদদের লাশ গযনী থেকে দূরে বহু দূরে বুলন্দশহর, মথুরা, মহাবন, কনৌজের মাটিতে, গঙ্গা যমুনার স্রোতধারায় ভেসে গেছে। যমুনা গঙ্গার তীরে হাজারো মুজাহিদের লাশ কবর দিতে হয়েছে। যাদের চিহ্নও কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে। সেইসব মর্দেমুজাহিদ হিন্দুস্তানের কুফরীর জগদ্দল পাথর থেকে সেখানকার নির্যাতিত নিপীড়িত সাধারণ মানুষদের মুক্তি দেয়ার এক অদৃশ্য বাসনা নিয়ে স্ত্রী, পুত্র, পিতামাতা আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে গযনী থেকে শত শত মাইল দূরবর্তী হিন্দুস্তান অভিযানে শরীক হয়েছিলেন। তাদের ঈমানী শক্তি, বিজয়ের জয়দীপ্ত ব্যাকুলতা, আল্লাহর বাণীকে কুফরস্তানে উচ্চকিত করার আকাঙ্ক্ষা তাদেরকে স্থির থাকতে দেয়নি। তাদের হৃদয়ে ছিল আল্লাহ্ প্রেমের আগ্নেয়গিরি। বুকের ভেতরে ছিল কুফরী নির্মূলের দাবানল। ঈমানের উত্তাপ তাদেরকে আমৃত্যু লড়াই করে যেতে অনিঃশেষ শক্তি সঞ্চার করেছিল।